নিজস্ব উড়োজাহাজে হজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি!

Hajjএভিয়েশন নিউজ: বিতর্কিত ‘কাবো’ নেই বলে এবার হজ ফ্লাইট পরিচালণার জন্য উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়ার সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করেছে বিমান। অথচ এবছর সবচেয়ে বেশি যাত্রী হজে যাচ্ছেন। বিমান বলছে, নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়ে এবছর হজ যাত্রী পরিবহন করা হবে। সেই ক্ষেত্রে হজ চলাকালীন সময়ে কিছু রুট ও ফ্লিট কাটছাট করা হবে। বিমান ম্যানেজমেন্ট থেকে এধরনের পরিকল্পনা পেয়ে গত শনিবার বিমানের পরিচালনা পর্যদ সর্বসম্মতি ক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রতি বছর যাত্রী কম থাকলেও বিমান ‘ওয়াইড বডির’ বেশি আসনের উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়। এবার কমপক্ষে ১০ হাজার হজ যাত্রী বেশি হলেও বিমান বড় কোন এয়ারক্রাফট ভাড়া না নিয়ে ৪১৯ আসনের ৩টি নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে হজ যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি হবে বিমানের জন্য। জানাগেছে ছোট উড়োজাহাজ দিয়ে হজ যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত নিলেও বিমান এখন পর্যন্ত কতগুলো স্লট পেয়েছে তা বলেনি। সৌদি আরব কতৃপক্ষ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ ৯০টি স্লট (জেদ্দা বিমান বন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের অনুমতি) দিতে পারবে বিমানকে। কিন্তু বিমানকে নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়ে ৫২ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করতে হলে কমপক্ষে ১১০টি স্লট নিতে হবে।

গত রোববার পরিচালণা পর্যদের সিদ্ধান্তটি অনুমোদনের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠালেও গতকাল পর্যন্ত তা অনুমোদন দেয়নি। মন্ত্রণালয়ের একটি সুত্র বলেছে, বিমান নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়ে হজ পরিবহনের সিদ্ধান্ত নিলেও এক মাসে ৫২ হাজার হজ যাত্রী পরিবহনের সুস্পষ্ট বহর পরিকল্পনা দেয়নি। হজ চলাকালীন সময়ে যদি কোন এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল বা নষ্ট হয়, কিংবা বার্ড হীটের ঘটনা ঘটে তাহলে সে বিপর্যয় কিভাবে সামাল দেবে তাও বলেনি। তাছাড়া নতুন উড়োজাহাজ আসার পর যেসব নতুন রুট চালু হয়েছে সেগুলো কিভাবে চলবে তাও জানায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হজের উড়োজাহাজ লীজ নিয়ে প্রতি বছর নানা কেলেংকারীর ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত খুবই ভাল। তবে হজ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এনিয়ে পরিকল্পনাহীন, হালকা ও স্বেচ্চাচারি কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটা হবে আত্মঘাতি। তাদের মতে বিমানের প্রকৌশল শাখার ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির আখড়া। শুধু প্রকৌশল শাখাই নয়, প্রতিটি বিভাগে সার্বক্ষনিক ঘাপটি মেরে থাকে নানা সিন্ডিকেট চক্র। আছে আন্তজাতিক মাফিয়া চক্রের এজেন্ট। যারা উড়োজাহাজ লীজ দেয় তাদের অষংখ্য মাফিয়া সদস্য বিমানে চাকরী করছে। আন্তজাতিক চোরাচালান চক্রও মিশে আছে বিমান কর্মীদের সঙ্গে।

এই চক্রটি চোরাই পন্য লুকানোর জন্য বিমানের মুল্যবান পার্টস ও যন্ত্রাংশ পর্যন্ত কেটে ফেলতে দ্বিধাবোধ করছে না। সেক্ষেত্রে হজ যাত্রী পরিবহন শুরু হলে যদি কোন কারণে একটি উড়োজাহাজ নষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে খোদ রাস্ট্রের পক্ষেও সে বিপর্যয় সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। কোন পার্টস নষ্ট হলে সেটা কিনে আনতে কিংবা মেরামত করতেও ২/৩ দিন লেগে যায়। অভিযোগ রয়েছে প্রকৌশল শাখায় এমন কিছু আন্তজাতিক সিন্ডিকেট চক্র আছে যাদের বিরুদ্ধে কারণে অকারণে উড়োজাহাজ নষ্ট করে দেয়ার অভিযোগ আছে। যন্ত্রাংশ বিকল করে করে দিচ্ছে। ৫/১০ হাজার টাকা বিনিময়ে যে কোন বিপর্যয়ও ঘটিয়ে দিতে পারে এই চক্রটি। এসব ঘটনায় অনেকে চাকরীও হারিয়েছে অতীতে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এবছর হজ যাত্রীর সংখ্যা ৫২ হাজার। বিমানের নিজস্ব তিনটি উড়োজাহাজের প্রতিটির আসন সংখ্যা ৪১৯টি। এ হিসাবে বিরতীহীনভাবে প্রতিদিন ৩টি করে ফ্লাইট করলেও এক মাসে তিনটি উড়োজাহাজ দিয়ে সর্বমোট ৩৭ হাজার ৭শ হজযাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে। মন্ত্রণালয় বলছে, বাকী ১৪ হাজার হজ যাত্রী কিভাবে পরিবহন করবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। তবে সপ্তাহে ঢাকা জেদ্দা রুটে ৩টি সিডিউল ফ্লাইট দিয়ে যাত্রী পরিবহনের কথা বলেছে বিমান।

হিসেব অনুযায়ী দেখা গেছে সপ্তাহে তিনটি সিডিউল ফ্লাইট মিলে মাসে ১২টি ফ্লাইট পাচ্ছে বিমান। যদি ১২টি ফ্লাইটে নিয়মিত সব যাত্রী বাদও দেয়া হয় তারপরও সর্বোচ্চ ৫ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ট্রাভেল এজেন্ট মালিক স্বপন কুমার সাহা জানান, হজ মৌসুমে এমনিতে সৌদিআরব যাতায়াতকারী যাত্রী বেশি। সিডিউল ফ্লাইটে গড়ে ২০ থেকে ৫০ জন হজ যাত্রী পরিবহন সম্ভব হতে পারে। এতে সব মিলিয়ে ৬শ যাত্রী পরিবহন করা যাবে।

বিমাম ন্ত্রণালয়ের একটি সুত্র জানায়, আজ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হজ নিয়ে যৌথ বৈঠক হবে। সেখানে হজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) নেতৃবৃন্দ, সৌদিয়া এয়ারলাইন্স, বিমান ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকবেন। মুলত ওই বৈঠকেই হজ যাত্রী পরিবহনে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

হজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ হাব নেতা কাজী মাহবুর হোসেন জানান, ফ্লাইট শুরু এবং শেষ দিকে হজ যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। সাধারণ হজ যাত্রীরা আগে যেতে চান। ব্যবসায়ী ও চাকরীজীবীরা শেষ দিকে অল্প সময়ের ব্যবধানে হজ করতে চান। একারণে মাঝখানে ৮/১০ দিন হজ যাত্রীর অভাবে বিমানকে অনেক ফ্লাইট খালি নিতে হয়। প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটছে। কাজেই বিমান তিনটি উড়োজাহাজ দিয়ে হজ প্যাকেজ পরিচালনার যে হিসেব তারা তৈরী করেছে সেটি বাস্তব সম্মত নয়।

এটা ধরতে গেলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। তাছাড়া বিশ্বের সব এয়ারলাইন্স কতৃপক্ষ পুরনো এবং বড় উড়োজাহাজ দিয়ে হজ যাত্রী পরিবহন করে। কারণ হজ যাত্রীদের অধিকাংশ বয়স্ক ও মহিলা। অধিকাংশই জীবনে উড়োজাহাজে ভ্রমন করেননি। এই ক্ষেত্রে হজ যাত্রী পরিবহনের কারণে এক মাসে বিমানের ব্র্যান্ড নিউ এয়াক্রাফটগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও হবে কমপক্ষে ১০/১৫ কোটি টাকার বেশি। বিষয়টি সমাধানে তিনি এবছর থার্ড ক্যারিয়ার উন্মুক্ত করার দাবি জানান। এতে হজ যাত্রীরা অল্প খরচে হজ করবে পারবেন।

সাবেক মন্ত্রী ও বেসামরিকম বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি লে. কর্ণেল (অব.) ফারুক খান বলেন, থার্ড ক্যাারিয়ার হজ যাত্রীদের নানাভাবে দুর্ভোগে ফেলে। সৌদি আরবের ও বিধিনিষেধ রয়েছে থার্ড ক্যারিয়ার নিয়ে। সিডিউল ফ্লাইটে বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে নানা কষ্ট দিয়ে হজ যাত্রীদের জেদ্দা নিয়ে যায় তারা। এতে নানা দুর্ভোগে পড়েন হজ যাত্রীরা। ফেরার পথেও অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয় হাজীদের।

বিমান পরিচালণা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন জানান, প্রাথমিকভাবে হজ যাত্রীর সংখ্যা ৫২ হাজার বলা হলেও বাস্তবে ভিসা না পাওয়া, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ নানা কারণে এই সংখ্যা আরো ৪/৫ হাজার কমে যায়। গত বছরও এরকম হয়েছিল। তিনি বলেন, এবছর তাদের হাতে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। এরমধ্যে ৩টি উড়োজাহাজ ফ্লিট থেকে তুলে এনে সেগুলো দিয়ে ‘ডেডিকেটেড’ হজ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ওইসব ফ্লিটে মিশর থেকে ভাড়ায় আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ দেয়া হবে।

সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু লোকসানী রুট ও ফ্লিট কাটছাট করা হতে পারে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বোর্ড সভায় প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট চালাতে পারলে বিমান যাত্রী প্রতি ২শ থেকে ৩শ ডলার লাভ করতে পারবে। লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি বিমানকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।

এদিকে হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিমান ইতোমধ্যে ৪৫০ আসনের উর্ধ্বে ১টি উড়োজাহাজ লীজ নিতে দরপত্র আহবান করেছে। এতে ২টি কোম্পানী দর জমা দিয়েছে। জানাগেছে এবছর বিতর্কিত ও সমালোচিত কাবো এয়ারলাইন্স দরপত্রে অংশ নেয়নি। অভিযোগ মুলত কাবো না থাকার একারণে বিমান ম্যাানেজমেন্ট হজের জন্য এবার উড়োজাহাজ লীজ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.