বিনিয়োগ বাড়াতে করপোরেট কর সহনীয় করার দাবি ব্যবসায়ীদের

taxজোবায়ের আহম্মেদ অভি: বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে করপোরেট কর কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, পুঁজিবাজারের মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে করপোরেট কর কমিয়ে আনার পাশাপাশি কর হারের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মধ্যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। আসছে বাজেটেই করপোরেট কর কমিয়ে এনে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা গেলে দেশের অর্থনীািততে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলেও মত দেন তারা। বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও পুঁজিবাজারের মন্দাবস্থা কাটাতে সরকার আগামী বাজেটে করপোরেট কর হার ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ কমিয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

তারা বলছেন, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করপোরেট করের হার অনেক বেশি, যা বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। বাংলাদেশ-গ্রীস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র জেনারেল সেক্রেটারি মাহমুদুর রহমান বলেন, “ব্যবসার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে করপোরেট কর কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে করপোরেট ট্যাক্সেশনটা অনেক বেশি। আর করপোরেট কর বেশি হলে সবার মধ্যে কর ফাঁকি দেয়ার একটা প্রবণতা কাজ করে। ট্যাক্স কমানো গেলে এ প্রবণতা থাকবে না।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভিন্ন ভিন্ন করপোরেট কর হারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “করপোরেট করের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ও দরকার। যারা কর দিচ্ছেন তাদের উপর আরো কর চাপিয়ে দিলে হবে না। রপ্তানি খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট জাহিন স্পিনিংয়ের পরিচালক আরো বলেন, “করপোরেট কর ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা উচিত। আমাদের দেশে করপোরেট করের ক্ষেত্রে নানা ধরণের বিভাজন রয়েছে। এ বিভাজন ঠিক নয়। ৩৭%, ৩৭.৫%, ৪০%, ৪২%-ইন্ডাস্ট্রি ভেদে করপোরেট করের ক্ষেত্রে এ রকম বিভিন্ন স্ল্যাব রয়েছে। এগুলো অর্ধেকে নামিয়ে আনলে ব্যবসা বাড়বে। বিনিয়োগে উৎসাহ পাবেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে কথা হয় ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “বিশেষ করে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশেই সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ করপোরেট কর নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে অফশোর ও অনশোর উভয় ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ কর প্রযোজ্য। এতে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে।

বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে, কর্পোরেট কর কমানোর পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেন তিনি। বার্জার পেইন্টের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনে করেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করপোরেট করের উচ্চ হার অন্যতম বড় বাঁধা। তাই বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা বাড়াতে বিভিন্ন খাতের করপোরেট কর যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা উচিত। আমাদের প্রস্তাব হলো, শেয়ারবাজারে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির উপর আরোপিত করহার কমিয়ে ৩০ শতাংশে নির্ধারণ করা। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের করহার কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া বর্তমানে সব ধরনের হিসাবে আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য থাকায় ব্যাংক গ্রহীতাকে দ্বৈত কর পরিশোধ থেকে মুক্তি দিতে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তিনি।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়- এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হলেও অন্য করপোরেট করহারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর দিতে হয় সিগারেট প্রস্তুতকারী এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোকে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিগারেট কোম্পানী ও মোবাইল কোম্পানির কর্পোরেট কর ৪০ শতাংশ এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানীগুলোর কর ৪৫ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়।

রূপালী চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি ঘোষিত ভারতের বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কারণ দেশটি শিল্পে আরও বিনিয়োগ চায়। আমাদের দেশেও করপোরেট কর কমাতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে রাস্তাাঘাট নির্মাণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে করপোরেট কর কমিয়েছে ভারত সরকার। আগামী চার বছরের জন্য দেশটিতে করপোরেট খাতে আরোপিত কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতির গতি ফেরাতে জাপানও করপোরেট কর ২ দশমিক ৫১ শতাংশ কমিয়ে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করেছে, যা আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর হচ্ছে।
এছাড়া চীন ২০০৮ সালে এবং ইন্দোনেশিয়া ২০১০ সালে করপোরেট কর কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

যুক্তরাজ্যও করপোরেট কর ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০১৫ সালে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। মরিশাসে বর্তমানে করপোরেট কর ১৫ শতাংশ ও সিঙ্গাপুরে ১৭ শতাংশ হারে নির্ধারিত আছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক আবুল বাশার বলেন, “কার্যত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে করপোরেট কর সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন খাতের নির্ধারিত হার থেকে সবচেয়ে কম হারটি- যা মাত্র এক শতাংশ কোম্পানির ক্ষেত্রে আরোপিত দেখিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে করপোরেট কর হার সব চেয়ে কম। এভাবে ভুল সংখ্যা উপস্থাপন করে তৈরি হচ্ছে ভুল নীতিমালা, যা জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই সময় এসেছে, করপোরেট করহার না কমানোর গো ধরা অবস্থান থেকে সরে এসে পুনর্মূল্যায়ন করার। হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং পুঁজিবাজারের মন্দাভাব কাটাতে করপোরেট কর কমানোসহ সরকারকে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি হোসেন খালেদ।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রস্তাব, মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করের হার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ, তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করের হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ এবং ব্রোকারেজ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে করপোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হোক। এই কর হার কমালে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। ব্যবসাবান্ধব করনীতি হলেই ব্যবসায়ীরা কর ও ভ্যাট দিতে আগ্রহী হবে। কর আইনে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া ও করপোরেট কর কমানো দরকার।”

ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি এবং ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রেজা ইফতেখার তার খাত অর্থ্যাৎ ব্যাংক খাতে করপোরেট কর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানান। আর এই কারণেই শেয়ারহোল্ডাররা ভাল লভ্যাংশ পাচ্ছেন না, তাই ব্যাংকে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে না। তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে কোনো স্থবিরতা না থাকলেও আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের গ্রহণযোগ্য লভ্যাংশ দিতে চাইলেও লাভ না হলে সেটা সম্ভব না। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। ব্যাংকের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এ হার সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকের অপারেটিং প্রফিট বেশি হলেও প্রভিশনসহ সবকিছু বাদ দিয়ে ২০ শতাংশের বেশি আসল লাভ থাকে না।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.