চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে ‘আন্তঃমহাদেশীয় অপরাধ চক্র’ সংঘবদ্ধ অপরাধের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সন্দেহ করছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।গত দুই বছরে সূর্যমুখী তেলের সঙ্গে মিশিয়ে আনা তরল কোকেন, ভারতীয় জাল রুপি এবং সর্বশেষ আটক ১২টি কন্টেইনারে বিপুল পরিমাণ মদ-সিগারেট পাওয়ার পর তাদের এই সন্দেহ।
এই সপ্তাহেই মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা দুই চালানের ১২টি কন্টেইনারে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা মূল্যের সিগারেট, মদ, টেলিভিশন ও ফটোকপিয়ারের সন্ধান মেলে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, “একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই চোরচালানে জড়িত। এ ধরনর অপরাধকে ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বা আন্তঃমহাদেশীয় অপরাধ বলে।
“এত বিপুল অঙ্কের পণ্য আমদানির পেছনে অন্য কারও বিনিয়োগ থাকতে পারে। বড় কোনো অপরাধী চক্র থাকতে পারে। আবার নাশকতাকারীরাও জড়িত থাকতে পারে।”
সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে নাশকতাকারীরাই সিগারেট ও মাদক চোরাকারবারে জড়িত।
এবার আটক ১২টি কন্টেইনারের চালানে আমদানি ও রপ্তানিকারক কোনো প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব পাননি শুল্ক গোয়েন্দারা।
পাশাপাশি একই আমদানিকারকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে গত এক বছরে যে ৭১টি কন্টেইনার বন্দর থেকে ছাড় হয়েছে, তাও ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।
এসব কন্টেইনারে কী ছিল, সেসব পণ্য কীভাবে ছাড় পেল, এখন তা কোথায় আছে এবং এই বিপুল অঙ্কের পণ্য কারবারের নেপথ্যে কারা, তার খোঁজে মাঠে নেমেছেন তারা।১২টি কন্টেইনার আটকের পর অনেক বিষয় সামনে আসছে বলে মন্তব্য করেন মইনুল খান।
“আগের ৭১টি কন্টেইনার ছাড় হল কীভাবে, সেগুলো পরীক্ষা ও স্ক্যান করা হয়েছিল কি না এবং স্ক্যানিংয়ের ছবি আছে কি না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য আমাদের হাতেও এসেছে।”
চীনের যে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে তার কোনো অস্তিত্ব পায়নি শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে এসব পণ্য এসেছে।
“কোনো আমদানিকারকের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়।এখানে আন্তঃমহাদেশীয় চক্র জড়িত।তারাই সংঘবদ্ধভাবে চোরাকারবার বা অন্য অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করছে,” বলেন মইনুল খান।
সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শূন্য শুল্ক ঘোষণার যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলো যাচাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ।
“কারণ অপকর্মগুলো সেখানেই বেশি হয়।তাই এগুলো বিশেষভাবে যাচাই করে দেখতে বলা হয়েছে।”
আমদানি পণ্য ছাড়ের সঙ্গে অনেকপক্ষ জড়িত থাকে; যেমন- কাস্টমস, ব্যাংক, বন্দর, শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ড।
“এসব ঘটনায়ও কেউ না কেউ জড়িত থাকতে পারে। তা আমরা খুঁজে বের করব। আমাদের বন্দর ব্যবসহার করে কোনো অপরাধ করতে দেব না,” বলেন মইনুল খান।
জাহাজ থেকে কন্টেইনার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা
গোয়েন্দারা জানান, সর্বশেষ দুই চালানের ১২টি কন্টেইনারের তথ্য তারা পেয়ে গেছেন জানতে পেরে পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রথম চালানের কন্টেইনারগুলো যাতে ধরা না পড়ে, সে জন্য সব চেষ্টাই তারা করেছিল।
প্রথম চালানটি ঢাকার খিলক্ষেতের হিনান আনহুই এগ্রো এলসি প্রতিষ্ঠানের নামে আনা হয়। জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর আগেই চালানটির শুল্কায়ন করা হয়।দ্বিতীয় চালানটি আনা হয় কেরানীগঞ্জের এগ্রো বিডি লিমিটেডের নামে। শুল্কায়ন নথি অনুযায়ী দুটি চালানের রপ্তানিকারক চীনের যম রাজ ইন্ডাস্ট্রিজ।
মইনুল খান জানান, “শুরুতে তারা কন্টেইনারগুলো জেটিতে না নামিয়ে জাহাজেই রাখতে চেয়েছিল।এজন্য আবেদনও করে। সফল হতে না পেরে কন্টেইনারগুলো জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়ারও চেষ্টা করে চক্রটি।কিন্তু নজরদারির কারণে তা করতে পারেনি।”
চালান দুটির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রাম নগরীর ডিটি রোড ধনিয়ালা পাড়ার রাবেয়া অ্যান্ড সন্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জালাল উদ্দিন।
চীন থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে এমভি ভাসি সান জাহাজে করে প্রথম চালানের ছয়টি এবং সিনার সুভাং নামের জাহাজে করে অন্য ছয়টি কন্টেইনার চট্টগ্রামে আসে।
আমদানিকারক খোরশেদ আলম এর আগের ৭১টি কন্টেইনারেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়েছিলেন।
অস্তিত্বহীন কারখানার নামে যন্ত্রপাতির ঘোষণায় আনা ওই বিপুল পরিমাণ পণ্যের সন্ধানে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
এর আগে ২০১৫ সালের ৭ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের ড্রামে মিশিয়ে আনা তরল কোকেনের একটি চালান আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।বলিভিয়া থেকে চট্টগ্রামের মেসার্স খান জাহান আলী লিমিটেডের নামে আমদানি করা সূর্যমুখী তেলবাহী কন্টেইনারটি জাহাজে তোলা হয় উরুগুয়ের মন্টেভিডিও বন্দর থেকে। সেই চালানটিও সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল।
আদালতের নির্দেশে কন্টেইনারগুলো খুলে নমুনা পরীক্ষা করে বিসিএসআইআর ও বাংলাদেশ ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি তরল কোকেনের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে।
ওই মাদক চালানের সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য ও বলিভিয়ার চোরাকারবারিরা জড়িত ছিল বলে জানিয়েছিলেন শুল্ক গোয়েন্দারা।চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করে কোকেনের ওই চালান ভারতে পাচারের চেষ্টা ছিল বলেও তারা জানান।
এরপর ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আরব আমিরাত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি কন্টেইনার আটক করে গোয়েন্দারা। পরদিন সেটি খুলে ২ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ রুপির ভারতীয় নোট পাওয়া যায়।
গৃহস্থালি পণ্য ঘোষণা দিয়ে আনা এসব ভারতীয় মুদ্রা ধরার প্রায় আট মাস পর সিআইডি জানায় মুদ্রাগুলো জাল।