জোবায়ের আহম্মেদ অভি: আফ্রিকার দেশ গিনির বন্দরে পাঁচ মাস ধরে আটকে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন ২৭ জন বাংলাদেশি নাবিক। তাদের জাহাজ থেকে বন্দরে নামতেও দেওয়া হচ্ছে না। ‘এমভি দাহিয়াতুল কালবি’ নামের এই বাংলাদেশি জাহাজের নাবিকদের দেওয়া হচ্ছে না বেতন-ভাতাও। ইতিমধ্যে জাহাজে দেখা দিয়েছে পানি ও খাবার সংকট। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জাহাজের নাবিক ও ক্রুরা এখন শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে স্বজনদের। তাদের মতে, জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পারে। কিন্তু জাহাজ মালিক এ ক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। অথচ জাহাজের নেই প্রয়োজনীয় ইন্স্যুরেন্স। যে ধরনের জেনারেটর থাকার কথা তাও নেই জাহাজে। জানা যায়, বাংলাদেশের কন্টিনেন্টাল লাইনার এজেন্সিসের মালিকানাধীন ‘এমভি দাহিয়াতুল কালবি’ নামের ওই জাহাজ গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২৭ বাংলাদেশি নাবিক নিয়ে ছেড়ে যায়। ভারত থেকে চালবোঝাই করে গিনির কনাক্রি বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু গিনিতে ইবোলা প্রাদুর্ভাবের কারণে তখন সেই বন্দরে ভেড়েনি জাহাজ। কয়েক দিন পর কনাক্রি বন্দরে জাহাজ পৌঁছলে চাল খালাস করা হয়। পরে ওই চাল আমদানিকারক জাহাজ বিলম্বে পৌঁছার কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির অভিযোগ তুলে গিনির আদালতে মামলা করেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত নভেম্বর থেকে বন্দর ত্যাগের ছাড়পত্র পায়নি এমভি দাহিয়াতুল কালবি। তারপর থেকেই বহির্বন্দরে রয়েছে দাহিয়াতুল কালবি। জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের স্ত্রী মাছুমা ফেরদৌস গতকাল বলেন, ডায়াবেটিসের রোগী তাজুল ইসলামের নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়। ইনসুলিন ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীর জীবনই পড়ে ঝুঁকিতে। কিন্তু গিনির বন্দরে ভিড়তে না পারায় তাও জোগাড় হচ্ছে না। জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী মাশফিক-উল-হাসানের সঙ্গে তার চাচি শিরিন সুলতানার স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। শিরিন সুলতানা গতকাল বলেন, জাহাজের গুমোট পরিবেশের কারণে নাবিকদের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। রয়েছে খাবার ও পানির সংকট। কিন্তু জাহাজ মালিক তাদের বিষয়ে কোনো দায়িত্ব নিয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন না। নিয়ন্ত্রক সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নির্দেশও উপেক্ষা করছেন কন্টিনেন্টাল লাইনার এজেন্সিসের মালিক। সূত্রমতে, নাবিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে না জাহাজ মালিক কন্টিনেন্টাল কর্তৃপক্ষ। জাহাজের প্রয়োজনীয় জেনারেটর সেবা না থাকায় শুধু রাতে জ্বালানো হচ্ছে আলো। রান্না হচ্ছে একবেলা। একটানা জাহাজে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অসুস্থ নাবিকরা। যেখানে নয় মাসের বেশি জাহাজে নাবিকদের থাকা আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন, সেখানে বছর পেরিয়ে যাচ্ছে এই ২৭ নাবিকের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাবিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করার বিষয়টিও। নাবিকদের দুই মাসের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখা যেখানে আইন ভাঙার শামিল সেখানে ছয় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বেতন-ভাতা। এসব জানিয়ে জাহাজ থেকে ঢাকায় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে একাধিকবার চিঠিও পাঠিয়েছেন নাবিকরা। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, নাবিকদের চিঠি ও স্বজনদের যোগাযোগের পর কন্টিনেন্টাল এজেন্সির মালিককে ঢাকায় অধিদফতরে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখে সব কিছুর সমাধান হবে বলে মহাপরিচালককে জানান। সেই সঙ্গে পয়লা বৈশাখের মধ্যে নাবিকদের বেতন পরিশোধের অঙ্গীকারও করেন। কিন্তু নাবিকদের স্বজনরা জানিয়েছেন, এর কোনো কিছুই জাহাজ মালিক করেননি। ফোন করলেও ফোন ধরেন না। জাহাজের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন না মালিকপক্ষ। স্বজনদের মতে, যদি জাহাজ মালিকপক্ষ আন্তরিক হয়ে গিনিতে যোগাযোগ করে আইনি সুরাহার ব্যবস্থা করেন তাহলে উদ্ধার পাবেন নাবিকরা।
আরও খবর