বিমানের পাইলট-বিলাসিতা: দ্বিগুণ ব্যয়েও বিদেশিপ্রীতি!

bangladesh-biman-pilotএভিয়েশিন নিউজ: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে যেন ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে। লাভের মুখ দেখতে বিদেশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দিয়ে বাড়তি ব্যয় হলেও সংস্থাটির লোকসান কমানো যায়নি। তাই নিয়োগের এক বছরের মধ্যেই চলে যেতে হয় ব্রিটিশ নাগরিক কেভিন স্টিলকে। ফের বিদেশি এমডি নিয়োগের তৎপরতা চলছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে বিদেশি পাইলট নিয়োগের তোড়জোড়।

অথচ অবসরে পাঠানো হচ্ছে দেশের অভিজ্ঞ পাইলটদের। বসিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাডেট পাইলটদের। ফলে অন্য সংস্থাগুলোয় চলে যাচ্ছেন দক্ষ দেশি পাইলটরা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’ বিমান কর্তৃপক্ষের বেলায় এটি যেন উল্টে গেছে, ‘কতরূপ স্নেহ করি বিদেশের কুকুর ধরি, দেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’

এই বিদেশি পাইলটপ্রীতির নেপথ্যে তাদের কাছ থেকে বিমানের সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তাদের ‘কমিশন-বাণিজ্যের’ অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক লোভে বিদেশি বৈমানিক আনার ক্ষেত্রে তাদের নিজ-নিজ দেশের পুলিশের প্রতিবেদন, মানসিক স্বাস্থ্য-পরীক্ষাসহ অনেক দরকারি বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। সম্প্রতি ৩ শতাধিক যাত্রীসহ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এ ব্যাপারে ফাইট পরিচালন শাখা থেকে জানানো হয়, বোয়িং ৭৭৭-এর চালক-সংকট আছে। আপাতত তা সামাল দিতে এখন ৪ বিদেশিকে আনা হয়েছে। আরও ৮ জনকে শিগগিরই আনা হবে।

দেশের অভিজ্ঞ বৈমানিকদের ৫৭ বছর বয়সে অবসরে পাঠাচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষ। আবার তাদের চেয়ে বেশি বয়সের (৬২-৬৩ বছর) বিদেশি পাইলট আনা হচ্ছে দ্বিগুণ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। বিদেশিদের মূল বেতন মাসে ১২ হাজার মার্কিন ডলার এবং তা আয়করমুক্ত। পাঁচ তারকা হোটেলে আবাসনব্যবস্থাসহ সব সুবিধা ধরলে একজন বিদেশি পাইলটের পেছনে মাসে খরচ দাঁড়ায় ১৮ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি, বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে দেশি বৈমানিকদের সব মিলিয়ে বেতন এর অর্ধেকের মতো, ৯ হাজার ২০০ ডলার।

বিদেশিদের ৪ সপ্তাহ কাজের পর দুই সপ্তাহ ছুটি। অর্থাৎ ৩ মাসে ছুটি দাঁড়ায় এক মাস। আর একই বিমানের দেশি চালকরা এক মাস কাজ করে ৮ দিন ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও ছুটি পান মাত্র ৪ দিন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানে নানা বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে গত ৫ থেকে ৭ বছরে অন্তত ৩০ জন বাংলাদেশি বৈমানিক কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থায় চলে গেছেন।

দেখা গেছে, পাইলটদের অবসরে পাঠানো ইস্যুতে অসন্তোষ চলছে বিমানে। বাংলাদেশ সরকার অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করেছে। আর শ্রম আইন অনুযায়ী, বৈমানিকদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ তা মানছে না। অথচ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই বৈমানিকদের চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৫ বছর করেছে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই এ বয়সসীমা কার্যকর। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও এ ক্ষেত্রে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংস্থাটির দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী, বিমানে এমনিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাইলট নেই। নতুন ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর আসার পর বৈমানিকের চাহিদা আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) হিসাবে, প্রতিটির জন্য ৭ সেট করে বর্তমানে বহরের ৬টি বোয়িং ৭৭৭-এর জন্য অন্তত ৪২ সেট বৈমানিক প্রয়োজন। একজন ক্যাপ্টেন ও একজন কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার মিলে একটি সেট। অর্থাৎ ৬টি বোয়িং-৭৭৭-এর জন্য ৮৪ জন বৈমানিক প্রয়োজন।

অবশ্য বিমানের ফাইট অপারেশন শাখার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি বিমানের জন্য ৬ সেট করে ধরে মোট ৩৬ সেট বা ৭২ জন বৈমানিক দরকার। কিন্তু আছেন মাত্র ৪৭ জন। সামনে আরও উড়োজাহাজ আসবে। চাহিদাও বাড়বে। ফাইট পরিচালন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন উড়োজাহাজ কখন, কোনটা আসবে, সেটা ২০০৮ সালেই নির্ধারিত। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাওয়ার পর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আগে থেকে এ জন্য যথাযথ ক্রু পরিকল্পনা করতে পারেনি, বরং এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত বা সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেছেন।

বাংলাদেশিদের অবসরের বয়সসীমা না বাড়িয়ে কেন বিদেশি পাইলটদের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বিমান- এ প্রশ্ন তুলেছেন পাইলটরা। এ ব্যাপারে ফাইট পরিচালন শাখা থেকে জানানো হয়, বৈমানিকদের চাকরি চলে বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের চুক্তি অনুযায়ী। তাই সরকারি আইন অনুযায়ী বয়স বাড়ানো হয়নি। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া বোয়িং ৭৭৭-এর একাধিক দেশি বৈমানিককে ৭ হাজার ডলার বেতনে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার আয়কর কাটা যাবে এক হাজার ২০০ ডলার। এতে তারা সম্মত হননি। কম বেতন প্রস্তাব করে দেশি বৈমানিকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, বোয়িং ৭৭৭-এ একেকজন বৈমানিকের পেছনে শুধু প্রশিক্ষণ বাবদ ৭০ লাখ টাকার মতো খরচ হয় বিমান কর্তৃপক্ষের। তাদের অনেককেই মাত্র বছর দেড়েক চাকরির পরই অবসরে পাঠানো হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ রকম ১২ জনকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছর আরও ৪ জন অবসরে যাবেন। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া জ্যেষ্ঠ বৈমানিক ক্যাপ্টেন এসএম হেলাল বলেন, বিদেশ থেকে বেশি বেতনে বেশি বয়সীদের আনা হচ্ছে। আর এ দেশের পাইলটদের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কেন সংবিধান অনুযায়ী বৈধ সুযোগ পাবে না, সেটা বুঝতে পারছি না।

বাপাসূত্র জানিয়েছে, বিমান কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে চাকরির বয়স ৬২ বছর করে প্রশাসনিক আদেশ জারি করেছিল। কিন্তু তার পরও কিছু শর্ত যোগ করায় বাপা এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আন্দোলন করে এবং প্রশাসনিক সালিশি ট্রাইব্যুনালে যায়। ট্রাইব্যুনালের রায় বৈমানিকদের পক্ষে এলে বিমান কর্তৃপক্ষ নিম্ন আদালতে আপিল করে। তাতেও বিমানের হার হয়। এরপর উচ্চ আদালতে আপিল করে বিমান কর্তৃপক্ষ, যার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এদিকে নতুন করে পাইলট নিয়োগ নিয়ে চলছে শর্তের মারপ্যাঁচ। ন্যূনতম উড্ডয়ন অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেওয়ায় নতুন ক্যাডেটরা রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ২০১০ সালে ২০ ক্যাডেট পাইলটকে নির্বাচিত করে। তখন উড়োজাহাজ-সংকট থাকায় এদের মধ্যে ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাকি ১০ জনকে অপেক্ষমাণের তালিকায় রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব ক্যাডেট পাইলটের অনেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অপেক্ষমাণ ক্যাডেটদের নেওয়া তো দূরের কথা, প্রথম পর্বের ১০ জনেরই উড্ডয়ন-অভিজ্ঞতা হয়নি বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়ায়। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন পাইলটরা। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে একাধিক ক্যাডেট চিঠি দিয়েও কোনও জবাব পাননি।

অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষ এখন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা বাণিজ্যিক বৈমানিকের লাইসেন্স নিয়েছেন, তাদের সুযোগ করে দিতে চায়। এর খ—গ এসে পড়ছে তরুণ বৈমানিকদের পেশাগত জীবনের ওপর। বাংলাদেশ ফাইং একাডেমির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এ মুহূর্তে ফাইং একাডেমি থেকে পাস করে, বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্সধারী (সিপিএল-কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স) অন্তত ৬০ জন পাইলট বেকার।

এ ব্যাপারে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, কেভিন স্টিল চলে যাওয়ার পর মোসাদ্দিক আহমদ ভারপ্রাপ্ত এমডি। আপাতত তিনি কথা বলবেন না। আর চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের বক্তব্য জানতে ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

আমাদের সময়ের সৌজন্যে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.