জোবায়ের আহম্মেদ অভি: এম মনজুর আলম। ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে হয়েছিলেন নগরপিতা। ২২ বছরের জনপ্রতিনিধির দায়িত্বপালনকালে দক্ষ প্রশাসক হতে না পারলেও সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেননি কেউ। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হলেও মানবসেবায় ছিল যার জীবনের বড় পুঁজি। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও রাজনীতির ম্যারপ্যাঁচে পড়ে ঘাটছড়া বাঁধেন বিএনপি’র সঙ্গে। যিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাও ছিলেন।
কিন্তু মঙ্গলবার নির্বাচন বয়কটের সঙ্গে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণায় স্তম্বিত হয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনেরা। তার এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক মহলেও আলোড়ন তুলেছে। এ ঘোষণার সময় নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তার মেজ ছেলে সরওয়ার আলম। যাকে মনজুর আলমের উত্তরসূরি ভাবা হয়।
কেন রাজনীতি ছাড়লেন মনজুর আলম তা জানতে কথা হয় তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গেও। উঠে আসে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
মনজুর আলমের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন,‘নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় দলের নেতা-কর্মীদের আন্তরিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। ফলে ক্ষোভ এবং হতাশা থেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন মনজুর।’
এদিকে মনজুর ভোট বর্জন ও রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণার পরপর তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন,‘বিএনপি’র লোকজন মনজুর আলম থেকে সরে আসায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেয়র পদে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলেন।’
ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিএনপি নেতারা। তাদের দাবি,‘নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই সক্রিয় নেতা-কর্মীদের আটক করছে পুলিশ। পুলিশের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। ’
তারা বলছেন,‘তিনদিন ধরে নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ দিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। হাজার হাজার বহিরাগত সন্ত্রাসীরা মনজুর এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি। যারা ঢুকেছে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বের করে দিয়েছে। ভোট কেন্দ্রে কাউকে যেতে দেয়নি। ফলে নেতা-কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি। ’
এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নগর সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন,‘সরকারি দল যেভাবে ভোট ডাকাতি করেছে, ভোটারদের হুমকি-ধমকি ও হয়রানি করেছে এতে আমাদের প্রার্থী চরম হতাশা থেকে হয়ত রাজনীতি ছাড়ার কথা বলেছেন। ’
“রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত উনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। দলের কোন সিদ্ধান্ত নয়” যোগ করেন আমীর খসরু।
তিনি বলেন,‘উনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তাতে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তিনি একজন স্বচ্ছ মানুষ হিসেবে পরিচিত, স্বচ্ছ রাজনীতি তিনি পছন্দ করেন।’
মনজুরের এ ঘোষণার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় মো. আবদুর রহিম নামের এক ভোটার বাংলানিউজকে বলেন,‘বর্তমানে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা না থাকার কারণেই মূলতঃ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। দেশে সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ নেই। ভদ্রলোকদেরও বিভিন্নভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে। ফলে রাজনীতি থেকে সরে এসে তিনি প্রচলিত ধারার রাজনীতিবিদদের গালে চপেটাঘাত করেছেন। এটাকে সাধুবাদ জানানো উচিত।’
মঙ্গলবার সোয়া ১১টায় নগরীর দেওয়ানহাট উন্নয়ন আন্দোলনের নির্বাচনী কার্যালয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার সময় মেয়র প্রার্থী মনজুর আলম জানান,‘তিনি দুইবার মেয়র প্রার্থীসহ মোট ছয়বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তবে আগামীতে আর কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না।’
মনজুর বলেন,‘জীবনে ছয়বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে না দিয়ে জোরপূর্বক কেন্দ্র দখলের মতো পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। তাই আগামীতে আর কোন নির্বাচনে আমি অংশ নেব না। ’
মনজুর আলম বলেন,‘আমি সমাজ সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেখান থেকে দেশের সেবায় এসেছিলাম। কিন্তু যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তাতে রাজনীতিতে থাকার পরিবেশ নেই। তাই এটাই আমার শেষ নির্বাচন। ’
রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন,‘আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বুলেটের চেয়ে ব্যালট অনেক বেশি শক্তিশালী বলে মনে করি। কিন্তু এই ব্যালটে যদি মানুষ তার অধিকার প্রয়োগ করতে না পারে তাহলে এ নির্বাচনের কোন মানে হয় না। ’
তিনি বলেন,‘যে রাজনীতিতে মানুষের ভোটের অধিকার থাকে না, সম্মান থাকে না, সেই রাজনীতি করে লাভ কী। তাই হয়তো ক্ষোভ ও হতাশা থেকে মনজুর আলম এ ধরণের কথা বলেছেন।’
তবে এ ঘোষণা চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়া যাবে না বলে দাবি করেছেন বিএনপি’র এ জ্যেষ্ঠ নেতা।
এদিকে তিন সিটি কপোরেশনে বিএনপি’র ভোট বর্জন স্রেফ দুরভিসন্ধি বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন,‘জনগণ বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়টি বুঝতে পেরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গত কয়েকদিন নাগরিক কমিটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভুয়া অভিযোগ করেছে। ’
রাজনীতি থেকে মনজুর আলমের অবসরের প্রসঙ্গে ড. হাছান মাহমুদ প্রশ্ন তুলে বলেন,‘নির্বাচন নিয়ে যদি মনজুর সাহেবের অভিযোগ থাকত তবে তিনি শুধু নির্বাচন বর্জন করতেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি ও বিএনপিকে কেন বর্জন করেছেন?’
এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় অভিযোগের আঙ্গুল বিএনপির দিকেই। কারণ বিএনপি নেতাকর্মীরা মনজুর আলমের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে ছিলেন না।