হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহনব্যবস্থা মানসম্মত নয়। রয়েছে নিরাপত্তাঝুঁকি। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জসহ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম, লাগেজ কনটেইনার পরিবহন, লাগেজ বেল্টের সার্বিক অবস্থা, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস চেকিং পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে নানা অসংগতি তুলে ধরেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। বিমানবন্দরে দ্রুত অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম (এপিআইএস) চালুসহ নানা সুপারিশ করেছে গঠিত তদন্ত কমিটি। এটি বাস্তবায়িত হলে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া যাত্রীর ব্যাপারে আগাম তথ্য মিলবে।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ কমিটি গঠন করা হয়।
বিমানবন্দরসংশ্লিষ্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (ইমিগ্রেশন), কাস্টমস, এপিবিএন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যক্রমের বিবরণ তুলে ধরে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয় ৯ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে। তদন্তকাজের নেতৃত্বে ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বহিরাগমন ও নিরাপত্তা) এবং শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহন আধুনিকীকরণ এবং মানোন্নয়ন-সংক্রান্ত সাবকমিটির সভাপতি ড. রাখাল চন্দ্র বর্মন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হক এ বিষয়ে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে মূলত পর্যালোচনা হবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে।
বিমানবন্দরের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজালাল বিমানবন্দর পরিদর্শনে দেখা গেছে গ্রাউন্ড এরিয়ার লাগেজ বেল্টগুলো অত্যন্ত পুরনো। কিছু স্থানে ছিঁড়ে গেছে। অভাব পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের। যত্রতত্র পড়ে আছে আবর্জনা। অপর্যাপ্ত সিসিক্যামেরা দিয়ে মনিটরিং কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এর ফলে গ্রাউন্ড এরিয়াসহ গোটা এয়ারপোর্ট নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে। বিমানবন্দরের ভেতরে ফ্লাইট ইনফরমেশন ডিসপ্লে সিস্টেমের (এফআইডিএস) অভাব রয়েছে।
এ ছাড়া চেক-ইন সারিতে (বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ বুথ) পৃথক টিভি মনিটর স্থাপনের প্রয়োজন; যেখানে ফ্লাইট নম্বর, সময়, এয়ারলাইনসের প্রতীকসহ ডিপারচার ও অ্যারাইভালের তথ্য উল্লেখ থাকবে। ট্রলি পড়ে থাকে গ্রিন চ্যানেল ও রেড চ্যানেল এলাকায়। অনেক মানি চেঞ্জার বুথ বিমানবন্দর এলাকার স্থান দখল করে আছে। তা ছাড়া যত্রতত্র রয়েছে অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন, যা একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মান ক্ষুণœ করছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জিকা ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণে শুধু শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে রক্তের নমুনা সংগ্রহপূর্বক তাদের নাম-ঠিকানা রাখা হয়। এতে করে এ ধরনের রোগবিস্তারের আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া পরিদর্শনকালে ওই দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক মহিলা কর্মচারীকে ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ প্রতিবেদনে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে নিযুক্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অবস্থার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৮৩ সাল থেকে দায়িত্ব পালনকারী বিমানকে কোনো নির্দিষ্ট বিধিমালার আলোকে নিযুক্ত করা হয়নি। তাই এ দায়িত্ব বেবিচককে দিতে সুপারিশ করেছে কমিটি। তা ছাড়া কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইনস (নভোএয়ার-রিজেন্ট এয়ার ইত্যাদি) অনেক ইকুইপমেন্ট বিমানবন্দরে ব্যবহার করে, যা আইএটিএ নির্দেশনা মোতাবেক নয়। এ ছাড়া অ্যাপ্রোন এলাকায় রক্ষিত সমস্ত পরিত্যক্ত যন্ত্র/সরঞ্জাম অপসারণ করা জরুরি। এতে ফরেন অবজেক্ট ডেবরিজ (এফওডি) থেকে রক্ষা পেতে পারে এয়ারক্রাফট। বিশেষ করে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ইউনাইটেড, বিসমিল্লাহ, জিএমজি এয়ারওয়েজের অচল সরঞ্জাম অপসারণ অতিজরুরি।
প্রতিবেদনে বেবিচক প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের ক্রমশ ফ্লাইট সংখ্যা বাড়লেও আনুপাতিকহারে অবকাঠামোগত বিস্তার এবং জনবল বৃদ্ধি করা হয়নি।
বর্তমানে প্রতিটি চেক-ইন সারিতে লোগোসংবলিত টিভি মনিটর সংখ্যা ও আয়তন বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া প্রতি বহির্গমন ব্যাগেজ বেল্টে বিল্ট ইন ডুয়াল ভিউ এক্সরে মেশিন এবং ডুয়াল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন করা প্রয়োজন। অচল ক্যারুজাল দুটি পুনর্স্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হবে। যাত্রীদের ভ্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত দিকনির্দেশক (সাইনেজ) জরুরি ভিত্তিতে স্থাপন করা প্রয়োজন। এয়ারলাইনসের সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে ক্যারুজাল ‘সি’-এর কাছ থেকে নভোএয়ারের অফিসটি অন্যত্র সরানো যেতে পারে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে থাকা অচল উড়োজাহাজ, এয়ারলাইনসের পুরনো জিএসই যন্ত্রপাতি অ্যাপ্রোন এলাকা থেকে অপসারণ করে কার্গো ভিলেজসংলগ্ন ওল্ড আইটেমস ইয়ার্ডে রাখা। এগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
স্পেশাল ব্রাঞ্চ (ইমিগ্রেশন) প্রসঙ্গে সুপারিশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ এপিআইএস (অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম) দ্রুত চালুকরণ এবং বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অথরিটির সঙ্গে কানেকটিভিটি স্থাপনের ব্যবস্থা করা। আর কাস্টমস প্রসঙ্গে বলা হয়েছেÑ ম্যানুয়েল ও পুরনো পদ্ধতিতে কাস্টমস চেকিং করা হয়। এতে করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। তাই অটোমেটেড ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম চালু করে স্ক্যানার, ডিটেকটরস এবং সিসিটিভি স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এপিবিএন তথা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছেÑ বিমানবন্দর দেশের অন্যতম গেটওয়ে। তাই টেকসই নিরাপত্তাবলয় গঠনের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। বিদেশগামী যাত্রীদের ৬টি বহির্গমন প্রবেশ গেটের মাধ্যমে নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়। অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে বিমানবন্দরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ আছে। গেট এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ এপিবিএন সদস্য মোতায়েন করা যেতে পারে।
এ ছাড়া বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানসহ যাত্রী হয়রানি রোধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা দৃশ্যমান। বর্তমানে ২টি পদ রয়েছে তাই কমপক্ষে ৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন। আর যে কোনো বিমানবন্দরে কাস্টমসে গ্রিন চ্যানেল ও রেড চ্যানেল থাকে। শাহজালালের জন্য ডেডিকেটেড গেট থাকলেও সেটি বন্ধ। গ্রিন চ্যানেল দিয়ে সব যাত্রীকে যেতে হয়। চেকিং ভোগান্তি কমাতে এবং ট্যাক্সেবল আইটেম ডিক্লেয়ার করার সুযোগ তৈরিতে রেড চ্যানেল সচল রাখতে হবে। বিমানবন্দরের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ফ্লাইট হ্যান্ডলিং। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৩-১৪ ঘণ্টা অলস থাকলেও অবশিষ্ট সময়ে অতিরিক্ত ফ্লাইট ওঠানামা করে। তাই শিডিউলের ব্যাপারে নজর দিতে হবে।