জোবায়ের আহম্মেদ অভি: থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ চারটি দেশের ২৪১ দালালের নিয়ন্ত্রণে চলছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানব পাচার। ২০১৪ সালে এই দালালচক্র দেশের ৪০ জেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পাচার করে। মিয়ানমারের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড এ ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা দিচ্ছে।
পুলিশের একটি গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে পুলিশের একটি দল সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে মানব পাচারে জড়িত দালালদের তালিকা তৈরি ও মানব পাচার ঠেকাতে আট দফা সুপারিশ-সংবলিত গোপন প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠায়।
প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে তদন্ত দলের প্রধান ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার জানান, তালিকাভুক্ত দালালদের আটক করে উপকূলের মানব পাচার ঠেকানোর কাজ করছে পুলিশ। গত ৯ মার্চ হামিদ করিম নামে মিয়ানমারের এক দালালসহ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ মানব পাচার চক্রের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, মানব পাচারের বড় একটি চক্রের নেতৃত্ব দেন হামিদ করিম। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থান করে হামিদ প্রতি মাসে দুই থেকে তিনটি জাহাজে করে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করে থাকেন। দেশজুড়ে তাঁর নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে, যারা ৪০ জেলা থেকে পাচারের জন্য লোক সংগ্রহ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচারকারীরা ট্রলারে তোলার পর যাত্রীদের নির্যাতন করে। যাত্রীদের ১৫ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত সাগরে ট্রলারে ফেলে রাখা হয়। সে সময় শুধু শুকনো খাবার দেওয়া হয়। নারীদের যৌন হয়রানি করা হয়। প্রতিবাদ করলে হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। আর মুক্তিপণের টাকা না পেলে যাত্রীদের থাইল্যান্ড উপকূলের র্যাং ডং অঞ্চলের জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ও ট্রলারগুলো ফিরে যাওয়ার সময় যাত্রী নিয়ে যায়। মানব পাচারে মিয়ানমারের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সক্রিয় সহযোগিতা করে।
প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী হিসেবে ১১ জনের নাম তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা হলেন থাইল্যান্ডের ফুডাবা জেলার রোনাং থানার থেন, মং ও মানাকিং; মিয়ানমারের চট্ট জেলার আবদুল গফুর, দিল মোহাম্মদ; মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার আবদুল আমিন, আক্তার হোসেন, আবু তৈয়ুব; দক্ষিণ নয়াপাড়ার আনার আলী, রঙিখালী গ্রামের সলিম উল্লাহ, থাইয়ংখালীর মো. সুমন। মালয়েশিয়ান নারী মানাকিং থ্যাইল্যান্ড অবস্থান করে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করছেন।
প্রতিবেদনে দেশের ২৩০ জন মানব পাচারকারীর তালিকা তুলে ধরা হয়। ১ নম্বরে রয়েছেন পাবনার সুজানগরের হেমজপুরের মহসীনের (৪২) নাম। এর পরে আছে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নাজিরপুল গ্রামের শহিদ মিয়া (৩০), যশোরের ডুমুরখালীর মিলন হোসেন (২৫), নড়াইলের কচুয়াডাঙ্গার বিদ্যুৎ শেখ (৪০) ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মো. সেলিম ওরফে লম্বা সেলিমের নাম।
প্রতিবেদনে মানব পাচার প্রতিরোধে আট দফা সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, তালিকাভুক্ত দালালদের গ্রেপ্তার, মানব পাচারের ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের বিশেষ আদালতে বিচার, মানব পাচার মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পরিচালনা, মানব পাচারের মূল কেন্দ্র শাহপরীর দ্বীপে পূর্ণাঙ্গ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন, উপকূলীয় প্রতি জেলায় ওয়ার্ড-পর্যায়ে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি গঠন, টেকনাফ ও উখিয়া উপকূলের ৮০ কিলোমিটার সীমান্তে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ রোধ ও মানব পাচার ঠেকাতে নৌ-পুলিশের ইউনিট স্থাপন এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
আরও খবর