বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশ্ব জুড়ে এর ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও চীনে ঘটছে এর উল্লোটা। সম্প্রতি চীনে অনেকগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের পাশাপাশি বিদেশি সিনেমা, কিছু জায়গা ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ এই দেশের নাগরিকদের জীবন। রয়েছে সেন্সরশিপের আধিপত্য। আমাদের এবারের আয়োজনটা হলো চীনে কি কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা নিয়েই। বিস্তারিত লিখেছেন এম হোসাইন
এক এক করে আলোচনা করা যাক কোন কোন প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চীনের নাগরিকরা—
ইনস্টাগ্রাম
অবিশ্বস্য হলেও সত্য যে, চীনের কোনো নাগরিক চাইলেই তার কোনো ছবি ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ারদের উদ্দেশ্যে আপলোড করতে পারে না। কারণ, সেখানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা। এদিকে চীনের নাগরিকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম হলো ইনস্টাগ্রাম। ইনস্টাগ্রামে এমন নজরদারির কারণ হিসেবে পাওয়া যায়, ২০১৪ সালে হংকংয়ের গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন হয়। এ আন্দোলনের অসংখ্য ছবি ইনস্টাগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকেই দেশটির সরকার ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে।
টুইটার
আমাদের দেশেও টুইটারের ব্যবহার দেখা যায়। ইতোমধ্যে অনেকেই জরুরী টুইটারে বার্তা দিয়ে আলোচনায়ও এসেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও এর বাইরে নন। এ সুযোগ কোনো চীনা নাগরিক পাচ্ছে না। কারণ, চীনের অভ্যান্তরে টুইটার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিশেষ করে টুইটার ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক পালাবদল হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকগুলো দেশের ক্ষমতারও পালাবদল হয়েছে। পতন হয় কয়েক দশকের একনায়কতন্ত্রের। এ ভয় থেকেই চীনা প্রশাসন দেশটির মানুষকে টুইটার ব্যবহার করতে দিতে সমর্থন করে না।
গুগল
চীনা প্রশাসন যতগুলো বিষয় নিষিদ্ধ করেছে তার মধ্যে গুগলও রয়েছে। চীনা নাগরিকরা জিমেইল ব্যবহারের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। অনেক চীনা নাগরিক গোপনে জিমেইল ব্যবহার করেন। তারা স্বাভাবিক ইন্টারনেট থেকে এই সুবিধা পাচ্ছেন না। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) এর সাহায্যে তারা এই সুবিধাটা ভোগ করেন। চাইলেই তারা ইউটিউব থেকে নিজেদের পছন্দের ভিডিও দেখতে বা ডাউনলোড করতে পারছেন না।
ফেসবুক
বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বেশি। আমাদের দেশের হিসেবে বলা যায়, ফেসবুক ব্যবহার করতে করতে অনেকে আসক্ত হয়েছে। কিন্তু চীনাদের কাছে ফেসবুক এখনো অধরা রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় দাবি ওঠা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ নেই। ২০০৯ সালে বেইজিং ফেসবুক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে ছিল।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ কয়েকবার চীনে সফর করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও দেখা করেছেন তিনি। প্রশাসনের মন গলাতে পারেননি মার্ক জাকারবার্গ। এখন পযর্ন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।
পিন্টারেস্ট
চীনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর মধ্যে একটি হলো পিন্টারেস্ট। ছবি শেয়ারিংয়ের জন্য জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে বিশ্বে বেশ পরিচিত পিন্টারেস্ট। জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও চীনে এই সুবিধা ভোগ করতে অনেক ঘাম ঝড়াতে হয় নাগরিকদের। সেন্সর ব্যবস্থা এতোই কড়াকড়ি যে, এর সুবিধা ভোগ কারতে তার কয়েক গুণ বেশি কষ্ট করতে হয়। এতো কষ্টের পরও চাইলে কোনো নাগরিক সবরকমের ছবি পোষ্ট করতে পারেব না পিন্টারেস্টে।
শুধু সাজানো-গোছানো বাড়িঘর, রান্না, বিয়ে, ফ্যাশন কিংবা চুলের স্টাইলের ছবি পোস্ট করার অনুমতি আছে। অনুমতি ছাড়াই কেউ স্পর্শকাতর ছবি পোস্ট করছেন কি না, তা দেখার জন্য আছে শক্তিশালী পর্যবেক্ষক টিমও কাজ করছে চীনে। গত মাসে এ জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহারে নতুন বিধি-নিষেধ আরোপ করে দেয় চীনা সরকার।
স্ন্যাপচ্যাট
নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় মেসেজিং সাইট স্ন্যাপচ্যাটের নামও। এর বদলে চীনারা নিজস্ব প্রযুক্তির মাইক্রোব্লগিং সাইট ওয়েইবো ব্যবহার করেন। এটা ছাড়াও দেশটিতে স্থানীয় আরো বেশ কয়েকটি মেসেজিং সাইট চালু আছে। কিন্তু অজানা কারণে চীনা প্রশাসন স্ন্যাপচ্যাটের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কোনো ইচ্ছেই নেই। অনেকেই মনে করেন, নিজস্ব মেসেজিং সাইটকে জনপ্রিয় করতেই বেইজিং বৈশ্বিক সাইটের বিরুদ্ধে সংরক্ষণমূলক নীতি বহাল রেখেছে। যদিও চীনের নাগরিকদের কাছে স্ন্যাপচ্যাটের চাহিদা রয়েছে অনেক।
ওয়েবসাইট
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি ইন্টারনেট নির্ভর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ব্যবহারেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। চীনা প্রসাশনের কাছে জিম্মি রয়েছে হাজার হাজার ওয়েবসাইট। এ তালিকায় পর্নো ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে সাধারণ ওয়েবসাইট ও যুক্ত। যেসব ওয়েবসাইট মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে, চীনা সরকারের সমালোচনা করে, দেশটির নাগরিকদের জন্য সেসব সাইট ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা এই ধরনের অয়েব সাইট ব্যবহার করেন তাদের জন্য রয়েছে আইনী ব্যবস্থা।
ভিডিও ও ই-বুক
বিদেশি ওয়েব সাইট ও কনটেন্টের ওপর চীনা সরকারের হস্থক্ষেপ প্রায়ই আলোচনার বিষয় বস্তু হয়ে উঠে।
দেশটিতে ই-বুক পড়া কিংবা বিদেশি ভিডিও দেখার সুযোগ যথেষ্ট নয়। অ্যাপলের ই-বুক ও আই-টিউন সেবা প্রাপ্তি এবং ডিজনির ভিডিও দেখার সুযোগ চীনাদের কাছে অধরা। বিদেশি কোনো কোম্পানি চীনের মানুষের জন্য ই-বুক, ভিডিওসহ যেকোন ডিজিটাল সেবা দিতে চাইলে দেশটির সরকারের বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন হয়। কমিউনিস্ট পার্টি বিরোধী কোনো তথ্য কিংবা প্রচারণা না থাকলে, তবেই এগুলো ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়।
বিদেশি সিনেমা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি সিনেমা দেখাতেও রয়েছে চীনাদের নিষেধাজ্ঞা। তবে সব সিনেমাতে নয়। বিদেশি সিনেমে দেখার অনুমতি নেই চীনা নাগরিকদের। এত বড় দেশটিতে প্রতিবছর মাত্র ৩৪টি বিদেশি সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি রয়েছে। সেই অনুমতিটি নিতে হয়ে সরকারি দপ্তর থেকে। এ কারণে চীনারা হলিউডের সামপ্রতিক সুপারহিট সিনেমাগুলো দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তাইওয়ানি বংশোদ্ভূত পরিচালক অ্যাং লি দু’বার সেরা পরিচালক হিসেবে অস্কার পেয়েছেন। তার অস্কার পাওয়া সিনেমা ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেইন’ ও ‘লাইফ অব পাই’ দেখা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন চীনারা। অনেকেই মনে কারেন, চীনের সিনেমা এ কারণেই দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। দেশীয় সিনেমা দেখতে তাদের কোনো বাধা নেই। এখানে দলবদ্ধ হয়ে সিনেমা হলে যেতে দেখা যায় অনেক। বিশেষ করে যেদিন তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তাদের দলবদ্ধ হয়ে সিনেমা হলমুখী হতে দেখা যায় অনেক।
বইপত্র
চীনা নাগরিকদের বই পড়াতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। চাইলেই যেকোন বিদেশি বই প্রকাশ করতে পারেন না চীনা প্রকাশকরা। গণমাধ্যমও দেশটিতে সংরক্ষিত। সরকারি অনুমতি না পেলে প্রকাশিত হয় না কোনো বই কিংবা ডকুমেন্ট। শুধু বই পড়া কিংবা ছাপানোতেই সীমবদ্ধ নয়, জনপ্রিয় রাজনৈতিক পার্টি (তিব্বত ও কমিউনিস্ট) বিষয়ে কোনপ্রকার তথ্য প্রকাশ করাতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। চীনের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অর্জিত সম্পদের হিসাব প্রকাশেও আইনগত নিষিদ্ধতা রয়েছে। একমাত্র প্রশাসনিক অনুমতি পেলেই প্রকাশ করা যাবে এ সব তথ্য।