এভিয়েশন নিউজ: হজ যাত্রী পরিবহনের জন্য বিমানের নিজস্ব তিনটি উড়োজাহাজকে সিডিউল ফ্লাইট থেকে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তে হংকং, দিল্লী, ইয়াংগুনসহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৪টি গুরুত্বপুর্ণ রুট। একই সঙ্গে কাটছাট হচ্ছে লন্ডন, জার্মানী, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরসহ বেশিরভাগ রুটের সিডিউল ফ্লাইট। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিজস্ব তিনটি উড়োজাহাজ দিয়ে বিমান হজ ফ্লাইট করার সিদ্ধান্ত নিলেও তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার ৭শ হজ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। বাকী ১৫ হাজার হজ যাত্রী কিভাবে সৌদি আরব যাবেন তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বিমান বলছে, জেদ্দার সিডিউল ফ্লাইটের যাত্রীদের সঙ্গে আসন খালি সাপেক্ষে কিছু হজ যাত্রী পাঠানো যাবে। কিন্তু সেই সংখ্যা সর্বোচ্চ ৬শ থেকে ১ হাজার।
এদিকে ৭৭৭-৩০০ অরুণ আলো, পালকি আর রাঙ্গাপ্রভাত এর ‘রিপ্লেসমেন্ট‘ হিসাবে মিশরের ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকে ২৫০ আসনের দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফট ভাড়া নিলেও একটি উড়োজাহাজ এখনো ঢাকা পৌছেনি। কখন পৌছবে তারও নিশ্চয়তা নেই। বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কারণে অকারণে বহর পরিকল্পনা ছাড়া বিমান একের পর এক উড়োজাহাজ লীজ নিলেও হজের জন্য এবছর কোন ‘ওয়াইড বডি’র উড়োজাহাজ লীজ না নেয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, এবার বিতর্কিত ‘কাবো’ না থাকায় বিমান উড়োজাহাজ লীজ নেয়া থেকে সরে এসেছে। একটি সিন্ডিকেট কাবোর উড়োজাহাজকে হজের জন্য আনতে না পেরে এখন বিমানকে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাদের মতে ৪১৯ আসনের ৩টি ছোট উড়োজাহাজ কিভাবে এত হজ যাত্রী পরিবহন করবে এনিয়ে বিমানের নিজস্ব কোন পরিকল্পনা পর্যন্ত নেই। তাছাড়া ছোট উড়োজাহাজ দিয়ে হজ যাত্রী পরিবহন করতে হলে বিমানকে কমপক্ষে ১১০টি শ্লট নিতে হবে। জানাগেছে এবার সৌদি আরব বিমানকে মাত্র ৯০টি শ্লট দিবে হজ যাত্রী পরিবহনে। সেক্ষত্রে ৫২ হাজার হজ যাত্রী পরিবহন কোনভাবেই সম্ভব হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
হজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে হজের অচলাবস্থা কাটানোর জন্য থার্ড ক্যারিয়ার উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিকল্প অবস্থা সামাল দিতে বিমান ইতোমধ্যে ৫শ আসনের বেশি ১টি উড়োজাহাজ লীজ নিতে আরএফপি করে রেখেছে। সেখানে দুটি উড়োজাহাজ পাওয়া গেছে। যদি হজ যাত্রীর সংখ্যা না কমে তাহলে একটি উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আগামী ৮ মে বিমানের বোর্ড সভায় এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। সেই ক্ষেত্রে রুট বন্ধ এবং ফ্লাইট কাটছাট না করেই নির্ভিঘেœ হজ যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন।
উল্লেখ্য হজের উড়োজাহাজ লীজ নিয়ে প্রতি বছর নানা কেলেংকারীর ঘটনা ঘটে। পরিচালণা পর্যদ এবছর তাই কোন উড়োজাহাজ লীজ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমানের পরিকল্পনা, মার্কেটিং, প্রকৌশল শাখার প্রতিটি ঘাটে ঘাটে দুনীতি লুটপাট হচ্ছে অহরহ। মেরামতের নামে লুটপাট করতে কারণে-অকারনে উড়োজাহাজ বিকল করা হচ্ছে। স্পেয়ার পার্টস পরিবর্তনের নামে প্রায়শ বিমানের কোন না কোন উড়োজাহাজ হ্যাঙ্গারে পাঠানো হচ্ছে। তাছাড়া প্রায়শ বার্ড হীট সহ নানা কারণে উড়োজাহাজ টেকনিক্যাল হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক সময় দিনের পর দিন উড়োজাহাজ বসে থাকে। এই ক্ষেত্রে বিমানকে নিশ্চিত হতে হবে যে, নিজদের তিনটি উড়োজাহাজ দিয়ে এক নাগারে নির্বিঘ্নে দুই মাস ফ্লাইট পরিচালণ করা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা নিশ্চিত করতে না পারলে হজ নিয়ে এবার ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে।
সাবেক মন্ত্রী ও বেসামরিকম বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি লে. কর্ণেল (অব.) ফারুক খান বলেন, থার্ড ক্যারিয়ার হজ যাত্রীদের নানাভাবে দুর্ভোগে ফেলে। সৌদি আরবের ও বিধিনিষেধ রয়েছে থার্ড ক্যারিয়ার নিয়ে। সিডিউল ফ্লাইটে বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে নানা কষ্ট দিয়ে হজ যাত্রীদের জেদ্দা নিয়ে যাচ্ছে তারা। এতে নানা দুর্ভোগে পড়েন হজ যাত্রীরা। ফেরার পথেও অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয় হাজীদের। তিনি বলেন, প্রতি বছর হজ যাত্রী পরিবহনে একটি ওয়াইড বডির উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়া হয়। এতে বিমানের সিডিউল ফ্লাইটগুলো ঠিক থাকে। রুট কাটছাট করতে হয় না। টেনশন মুক্ত থাকা যায়। তাছাড়া তিনটি ব্র্যান্ড নিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে হজযাত্রী পরিবহন করলে দুই মাসে উড়োজাহাজগুলোর অর্ধেক বয়স কমে যাবে। সৌন্দর্য নষ্ট হবে। অল্প দুরত্বে ফ্লাইট চালানোর কারণে উড়োজাহাজগুলোর ‘সাইকেল’ নষ্ট হবে। যার ক্ষতিও অপুরনীয়। তার মতে এগুলো ভালভাবে চিন্তাভাবনা করে হজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর একবার রুট ও ফ্লিট কাটছাট করা হলে সেগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিমানকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, এবছর হজ যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় তারা প্রাথমিকভাবে একটি বেশি আসনের উড়োজাহাজ লীজ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু বিমান নিজস্ব ৩টি উড়োজাহাজ দিয়ে হজ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে বলায় তারা এখন কোন উড়োজাহাজ লীজ নিচ্ছেন না। তার মতে বিমান এতে বড় অংকের টাকা লাভ করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে কিছু রুট ও ফ্লিট কাটছাট করা হতে পারে।
বিমান পরিচালণা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে হজ যাত্রীর সংখ্যা ৫২ হাজার বলা হলেও বাস্তবে ভিসা না পাওয়া, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ নানা কারণে এই সংখ্যা আরো ৪/৫ হাজার কমে যাবে। গত বছরও এরকম হয়েছিল। এবছর তাদের হাতে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। এরমধ্যে ৩টি উড়োজাহাজ ফ্লিট থেকে তুলে এনে সেগুলো দিয়ে ‘ডেডিকেটেড’ হজ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ওইসব ফ্লিটে মিশর থেকে ভাড়ায় আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ দেয়া হবে। এটা পর্যবেক্ষনে তিনি বর্তমানে মিশরে অবস্থান করছেন। তবে মিশর যাওয়ার আগে তিনি স্বীকার করেছেন, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু লোকসানী রুট ও ফ্লিট কাটছাট করা হতে পারে।