দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ, আর অর্ধেক নারী। তবে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার পুরুষের অর্ধেক। দেশের ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী পুরুষদের ৮২ শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম। অর্থাৎ তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। নারীর ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৩৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক মনে করে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার পুরুষের সমান উন্নীত করা গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছে ২০১৩ সালের তথ্যভিত্তিক। এর ফল শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। ওই জরিপের তথ্য মতে, দেশে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৭ লাখ, যা ওই বয়স গ্রুপের মোট জনসংখ্যার ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ। নারীর অংশগ্রহণের হার অনেক কম থাকার কারণে শ্রমশক্তির আকার বাংলাদেশ অনেক কম। থাইল্যান্ডে ১৯৯০ সালে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল
৭৫ শতাংশ। একই সময়ে জাপানে ছিল ৪৮ শতাংশ।
মতামত জানতে চাইলে বিবিএসের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে পরামর্শক নুরুল কবির বলেন, বাংলাদেশের নারীদের একটি বড় অংশ গৃহস্থালির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শ্রম জরিপে গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের হিসাব করা হয় না। ১৯৮৮ সালে শ্রম জরিপে গৃহস্থালি কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে তা বাদ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারলে বর্তমানের তুলনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে দশমিক ৭ শতাংশ। এটিকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অতিরিক্ত ১ দশমিক ৬০ শতাংশ বাড়বে। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়িয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে সাত শতাংশে উন্নীতকরণ করা সম্ভব। যা বর্তমানে ছয় শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কম হওয়ার পেছনে সামাজিক, পরিবারিক এবং আইনগত কারণ রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের মালিকানায় পুরুষরা থাকায় ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যা সৃষ্টি হয়। এমন আইনগত বাধাগুলো নারীদের পিছিয়ে রেখেছে। আবার পুরুষদের মানসিকতার কারণেও নারীরা কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। কারণ নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে চাকরি দিতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, নারীরা ইট ভাঙা, গার্মেন্ট ও কৃষির মতো কঠিন কাজ করছেন। সুতরাং পুরুষের মতো সমান সুযোগ দিলে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে, যা অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এজন্য সরকারের বিশেষ নীতি সহায়তা প্রয়োজন। যাতে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে কোনো বাধা না থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের বেশি হতে হবে। প্রতি বছর ২১ লাখ নারীকে শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে। এজন্য অবকাঠামো এবং পরিবহন সেবায় বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় নারীদের অংশগ্রহণের হার ৯ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশও বিষয়টি বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিলে মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। শুধু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করলে হবে না, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, গত কয়েক বছর নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে সেটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পেঁৗছায়নি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যাতে আগামী বছরের মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা যায়। এ জন্য প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, ঋণ কর্মসূচি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীদের সম্পৃক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ সালের প্রাথমিক খসড়া প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের বেকার পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, সে হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ২০১৩ সালের হিসাবে দেশে বেকার ২৬ লাখ। ২০১০ সালেও বেকারের সংখ্যা একই ছিল। বিশাল এ বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ পায় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদ অনুযায়ী এ হিসাব তৈরি করা হয়েছে। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হবে। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরো শ্রমশক্তি জরিপে সপ্তাহে ১ থেকে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পায় এমন ব্যক্তির কাজের হিসাব জরিপে নিয়ে থাকে। এমন জনগোষ্ঠীকে অর্ধবেকার বলা হয়।
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের প্রাথমিক এ হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এ ধরনের অর্ধবেকার বেড়েছে এক কোটির বেশি। আর ২০১৪ সালে এসে তা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ১৫ লাখ। ২০১০ সালের জরিপে ১ কোটি ১০ লাখ অর্ধবেকারের হিসাব মেলে। অর্ধবেকাররাও শ্রমশক্তিতে যুক্ত হয়। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে দেশে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখের বেশি মানুষ কাজ পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলে বর্তমানে যে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি হারে কর্মসংস্থান হবে। এতে প্রতিবছর যতসংখ্যক মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হয়, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। উৎপাদন বাড়িয়ে শ্রমনির্ভর শিল্পের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের ওপর জোর দিতে হবে। উল্লেখ্য, বিভিন্নভাবে কাজের মধ্যে রয়েছে দেশের প্রায় ৫ কোটি ৮১ লাখ মানুষ। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪১ লাখ।
আরও খবর