বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে শ্রমিকের অভিশপ্ত জীবন: কোয়ার্টজের প্রতিবেদন

Ranz Plaza___2nd storyগেল ২৪ শে এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসের দ্বিতীয় বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিম্নমানের কর্মপরিবেশ, শ্রমিক নির্যাতন, কম মজুরি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনীহার কথা বার বারই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানা নিয়ে তেমনই একটি প্রতিবেদন দিয়েছে কোয়ার্টজ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঠিক যে কারণে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে কদর পেয়েছে সে একই কারণে শ্রমিকদের জন্য এ শিল্প ক্রমাগত মৃত্যু ফাঁদ হয়ে উঠছে।

কোয়ার্টজের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে যার বেশিরভাগই নারী। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচককে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন এসব মানুষ। স্বাধীনতার পর ৪০ বছর ধরে দারিদ্র্যের হার ৮০ ভাগ কমে ৩০ শতাংশেরও কমে এসে দাঁড়িয়েছে। আর গেল ২০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধির হার ৫-৬ শতাংশ।প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সম্প্রদায়ের অনেকে সফলতার জন্য লৈঙ্গিক সমতা এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করে থাকে। এমনকি এসব ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেও উল্লেখ করেন তারা। এছাড়া সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিপ্লবের অবদানের কথা উল্লেখ করে থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
তবে কোয়ার্টজের মতে, বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যে পোশাক শিল্পের অবদানের কথা উল্রেখ করা হচ্ছে সেখানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা এখনও অপর্যাপ্ত। অর্থাৎ যে পোশাক শিল্পই বাংলাদেশকে এত উঁচুতে নিয়ে গেছে সে পোশাক শিল্পই শ্রমিকদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। গেল দশকে বাংলাদেশ থেকে সস্তায় বিপুল পোশাক উৎপাদন করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে দ্বিগুণ বেশি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের রপ্তানি হয়েছে এদেশ থেকে। আর এর প্রায় ৯০ শতাংশই হয়েছে পোশাক শিল্পের মাধ্যমে। অর্থাৎ মোট রপ্তানির ২৮ বিলিয়ন ডলারই এসেছে পোশাক খাত থেকে।

কোয়ার্টজের প্রতিবেদনে বলা হয়, সস্তা শ্রম আর বাংলাদেশের শিথিল বিধান; যা রানা প্লাজা ঘটনার জন্য দায়ী; সে বিষয়গুলোই মূলত বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণ করে থাকে। জাস্ট জবস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক সাবিনা দেওয়ান বলেন, বাংলাদেশের সরকার কীভাবে পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষিত করা যায় সে পথে কাজ করছে।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য যে নিম্ন মজুরি ধরা হয়েছে তা বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি। এমনকি রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ন্যুনতম মজুরির চেয়েও অন্যান্য দেশে মজুরির হার বেশি। একদিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কম মজুরিতে পোশাক উৎপাদন করা যায় এমন দেশকে খুঁজে থাকে, আর অন্যদিকে আরেক রপ্তানিকারক দেশ চীনে শ্রমের দাম দিন দিনই বাড়ছে। সেদিক থেকে সস্তায় পোশাক তৈরির জন্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে খুবই আগ্রহের একটি জায়গা বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে বিভিন্ন জরিপের উপর ভিত্তি করে ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যৌথভাবে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, পরবর্তী দুই বছর চীনে উৎপাদন কমাতে আগ্রহী ক্রেতারা। একইসময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পোশাক খাতে অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
সত্যিকার অর্থেই কী এটি কোন উন্নয়নের নাম?
প্রতিবেদনে বলা হয়, তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে অত্যন্ত অমানবিক, হৃদয়ঘাতি এবং শোষণমূলক বাণিজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশি সাংবাদিক জাফর সোবহান। তাজরীনের প্রসঙ্গ টেনে জাফর সোবহান বলেন, ২০১২ সালে এসে না খেয়ে মরতে হয় এমন বাংলাদেশির সংখ্যা হাতে গোণা। তবে জীবন টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা এখন আর নেই।
আর জাফর সোবহানের সে মন্তব্যকে সমর্থন করে কোয়ার্টজের প্রতিবেদনে বলা হয়, “অনাহারে মৃত্যুজনিত সমস্যার সমাধান আগুনে পুড়িয়ে মারা নয়।” ১৯১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার ঘটনায় ১৪৬ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল। সেসময়, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের জন্য শ্রম-কোড এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুর একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে ওঠে তা। একইভাবে তাজরীনে আগুন, রানা প্লাজা ধসসহ গেল দশকে বিভিন্ন ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর বিষয়টি নিয়েও একইরকমের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বাংলাদেশের। তবে আদৌ সে পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কোয়ার্টজ। রানা প্লাজায় ভবন ধসের ঘটনার পর কারখানাগুলো পরিদর্শন এবং নিরাপত্তা জোরদারে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো থেকে সংগঠন গড়ে তোলা হয়। কারখানাগুলোর উন্নয়নে কিছু তহবিলেরও যোগান দেয় তারা।

বেসরকারি খাত, সেখানকার জনগোষ্ঠী এবং অগণিত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধানের সুপারিশ করেছে কোয়ার্টজ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজা ধসের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে পোশাক শিল্প এবং নৈতিকতার প্রশ্নে বিভিন্ন সচেনতামূলক কার্যক্রম চালিয়েছে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে ঠিক সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য যে ধরনের চাপ তৈরির দরকার, প্রতিষ্ঠানগুলো সে পথে হাঁটছে না বলে উল্লেখ করেছে কোয়ার্টজ।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.