বিমানের পরিকল্পনা: ৮৮ কোটি লাভ করতে ৩শ কোটি টাকা গচ্চা!

Biman-Bangladesh-Bhabanএভিয়েশন নিউজ: হজ ফ্লাইট করে ৮৮ কোটি টাকা লাভ করতে এবার ৩শ কোটি টাকা ক্ষতির পরিকল্পনা করেছে বিমান। জানাগেছে ৩ হাজার ৪শ কোটি টাকা দামের তিনটি ব্রান্ড নিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে অল্প দূরত্বের গন্তব্যে হজ ফ্লাইট করে এই টাকা ক্ষতি করতে যাচ্ছে। এতে বিমান দৃশ্যত কিছু লাভের মুখ দেখলেও অন্তরালে পুরো ৩শ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা করছে উড়োজাহাজ রক্ষনাবেক্ষন ও মেরামতকারী একটি সিন্ডিকেট।

আর এই কাজে ওই চক্রকে পুরোপুরি সহযোগিতা করছে বিমানের একটি মাফিয়া চক্র। এরা বিমান মন্ত্রনালয় ও পরিচালণা পর্যদকে ভুল বুঝিয়ে সদ্য ক্রয় করা তিনটি ব্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফটকে হজ ফ্লাইট পরিবহনের মতো কাজে লাগিয়ে উড়োজাহাজগুলো নষ্ট করার নীল নকশায় নেমেছে। এয়ারক্রাফট উৎপাদনকারী কোম্পানীর হিসাব অনুযায়ী এই ক্ষতি কমপক্ষে আড়াইশ থেকে ৩শ কোটি টাকা। এরমধ্যে বেশি দুরত্বের অর্থাৎ এক্সটেন্ডেন্ট রেঞ্জের (ইআর) জন্য তৈরী করা উড়োজাহাজকে অল্প দুরত্বের গন্তব্যে চালালে সাইকেল (রাউন্ড) নষ্ট করে ক্ষতি করা হবে কমপক্ষে ২শ কোটি টাকা।

অপর দিকে এয়ারক্রাফটটের সৌন্দর্য নষ্ট করে সেটিকে আগের মতে সাজাতে ক্ষতি হবে কমপক্ষে ১শ কোটি টাকা। এর আগে বিমানের একটি নতুন উড়োজাহাজকে দিয়ে হজ ফ্লাইট করে বড় অংকের টাকা ক্ষতি করেছিল বিমান। উলে­খ্য এবছর বিমান নিজস্ব তিনটি উড়োজাহাজ দিয়ে হজ ফ্লাইট করার সিদ্ধান্ত নিযেছে। এতে হজ শেষে বিমান কমপক্ষে ৮৮ কোটি টাকা লাভ করতে পারবে।

যুক্তরাস্ট্রের বোয়িং কোম্পানী সুত্রে জানাগেছে বর্তমানে বিমান বহরে থাকা চারটি ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফটকে বেশি দুরত্বের অর্থাৎ ঢাকা-লন্ডন, ঢাকা ফ্রাংফুট ও ঢাকা জেএফকে‘র মতো গন্তব্যে পরিচালণার উপযোগি করে তৈরী করা হয়েছে। এজন্য বিমানকে অতিরিক্ত অর্থও গুনতে হয়েছে। বহরের চারটি উড়োজাহাজ পালকি, অরুল আলো, রাঙাপ্রভাত এক্সটেন্ডেন্ট রেঞ্জের (ইআর) উড়োজাহাজ।

নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, ল্যান্ডিং গিয়ার, এপিইউ (অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট) এর মতো মুল্যাবান যন্ত্রাংশের জন্য সাইকেল (রাউন্ড ট্রিপ) নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অর্থাৎ যতবার বিমান ল্যান্ড (অবতরণ) ও টেকঅপ (উড্ডয়ন) করবে ততবার এক সাইকেল শেষ হবে। আর সাইকেল শেষ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতিগুলোকে আবার মেরামত শপে পাঠিয়ে ওভারহোলিং ও সাইকেল সংযোজন করতে হবে।

বোয়িং সুত্রে জানাগেছে বিমান যদি নতুন উড়োজাহাজগুলো দিয়ে দুই মাসব্যাপী হজ ফ্লাইট পরিচালণা করে সেক্ষেত্রে ঢাকা জেদ্দা রুটের জন্য প্রতিটি উড়োজাহাজের ফ্লাইট প্রতি ৩টি সাইকেল নষ্ট হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকৌশল শাখার একজন ইঞ্জিনিয়ার জানান, ঢাকা-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইটে ১ সাইকেল নষ্ট হয়। ওই পরিমান ভাড়া আয় করতে ঢাকা-জেদ্দা রুটে তিনটি সাইকেল নষ্ট করতে হবে। এতে এক দিকে নির্ধারিত সময়ের আগে উড়োজাহাজগুলোর সাইকেল নষ্ট হয়ে যাবে। অপর দিকে সাইকেল সংযোজনে বিমানকে তিনিট জাহাজের জন্য কমপক্ষে অতিরিক্ত ২শ কোটি টাকা গুনতে হবে। আর সময়ের আগে ওভারহোলিং করায় উড়োজাহাজের ফিটনেসও দ্রুত শেস হয়ে যাবে।

এছাড়া হজ ফ্লাইট করার কারণে মাত্র দুই মাসে নষ্ট হয়ে যাবে এয়ারক্রাফটগুলোর নান্দনিক দৃশ্য ও অপুর্ব সৌন্দর্য। ক্ষতি হবে নকশা, কার্পেট, টয়লেট। সিট ভেঙ্গে যাবে। ভিডিও স্ক্রীন ভেঙ্গে যাবে কিংবা নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে ওই এয়ারক্রাফট দুটিকে আবারো আগের সৌন্দর্যে ফিরিয়ে আনতে বিমানকে প্রতিটি উড়োজাহাজের পেছনে কমপক্ষে ৩০/৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। অর্থাৎ হজ যাত্রী পরিবহন করে বিমান যতটুকু লাভবান হবে তিনটি এয়ারক্রাফটকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তার তিনগুন টাকা খরচ হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, পৃথিবীর কোন এয়ারলাইন্স সংস্থা হজযাত্রী পরিবহনে এধরনের নতুন এয়ারক্রাফট ব্যবহার করে না। কারণ হিসাবে জানাগেছে, হজ যাত্রীদের অধিকাংশরই বিমানে চলাচল করার অভিজ্ঞতা থাকে না। টয়লেট ব্যবহার, খাবার খাওয়া, পানি ফেলা ইত্যাদি কোন কিছুরই তাদের অভিজ্ঞতা থাকে না। বেশিরভাগ বয়স্ক। হজ যাত্রী পরিচালণার অভিজ্ঞতা থেকে একজন কেভিন ক্রু জানান, হজ যাত্রীরা উড়োজাহাজে উঠেই প্লেনের দেয়ালে ও কাপেটে পানের পিক, পানি ও খাবারের উচ্চিষ্ট ফেলে একাকার করে ফেলেন। আসনের উপর দাড়িয়ে সিটের হাতল ভেঙ্গে ফেলেন। ব্যবহার করতে না জানায় অডিও, ভিডিও প্যানেল ও ভিডিউ স্ক্রীন ভেঙ্গে ফেলেন। টয়লেট ব্যবহার করতে না পেরে যত্রতত্র মলমুত্র ত্যাগ করে টয়লেট নষ্ট করেন।

জানা গেছে, সৌদিয়া এয়ারলাইন্সসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স সংস্থা হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকেন বহরে থাকা অপেক্ষাকৃত পুরনো উড়োজাহাজ দিয়ে। কিন্তু বিমান ম্যানেজমেন্ট জেনেশুনেও এটা না করে এবার হজ ফ্লাইট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা দামের ৩টি ব্যান্ড নিউ এয়ারক্রাফটি দিয়ে।

বিমানের একটি সুত্র জানায়, বর্তমানে বিমানের তহবিলে কোন টাকা নেই। যার কারণে তিন মাস পর এই তিনটি এয়ারক্রাফটকে আর সংস্কারও করা হবে না। এতে করে সম্পুর্ণ নতুন দুটি এয়ারক্রাফট চলে যাবে পুরনো এয়ারক্রাফটগুলোর কাতারে। এর বড় খেসারত দিতে হবে বিমানকে।

বিমান পরিচালণা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন ঢাকা জেদ্দা রুটে ফ্লাইট চালালে দ্রুত সাইকেল নষ্ট হওয়ার কথা স্বীকার করলেও এর বিকল্প নেই বলে জানান। তার মতে লীজ নিয়ে প্রতি বছর নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। তাছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, এমিরাটসের মতো বিমান সংস্থাগুলোও এখন অল্প দুরুত্বে ৭৭৭-৩০০ইআর এয়ারক্রাফট ব্যবহার করছে। কাজেই তারা পারলে বিমান পারবে না কেন? আর হজ যাত্রীরা ইহরামের কাপড় পড়ে উড়োজাহাজে উঠেন। বিমানে উঠার পর তারা আসন ছেড়ে নড়া চড়া পর্যন্তও করেন না। কাজেই জাহাজ নষ্ট করার কথা সঠিক নয়।

এ বিষয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা বিকাশ নারায়নের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স অল্প দুরত্বে উড়োজাহাজ চালিয়ে সাইকেল নস্ট করে যে পরিমান টাকা ক্ষতি করছে ভাড়ার টাকা থেকে তা তুলে নিচ্ছে। কারণ এসব রুটে তাদের ভাড়া বিমানের দ্বিগুন। এছাড়া তাদের বেশিরভাগ বিজনেস ক্লাসের (জে ক্লাস) টিকিট বিক্রি হয়। কিন্তু বিমানের বিজনেস ক্লাসের অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয় না। এছাড়া বেশিরভাগ ফ্লাইটের আসনও খালি থাকে। সেক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর কিংবা এমিরাটস এয়ারলাইন্সের সঙ্গে তুলনা করলে বিমানকে লোকসানে পড়তে হবে।

এদিকে এসব বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আজ বিমান পরিচালণা পর্যদের জরুরী সভা আহবান করা হয়েছে। বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। উলে­খ্য গত ৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান মন্ত্রনালয় পরিদর্শনে যান। এসময় তিনি বিমানের লাভ লোকসান, টিকিট বিক্রি, আভ্যন্তরিন ও নতুন রুট খোলা ও নিউইয়র্ক রুট পরিচাণনার বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। বিশেষ করে আগামী হজ মৌসুমে বিমানের হজ ফ্লাইট পরিচালণার বিষয়ে সর্বশেস প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন । প্রধানমন্ত্রী বলেন, হজ বাংলাদেশের মাসুলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কাজেই এখানে কোন অনিয়ম-দুনীতি টলারেন্স করা হবে না। হজ ফ্লাইট নিয়ে যাতে কোন বিপর্যয় না ঘটে সেজন্য অগ্রিম সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন তিনি।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.