আঠারো বছর অপেক্ষার পর অবশেষে খুলনায় নির্মিত হতে যাচ্ছে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর। বাগেরহাটে নির্মিতব্য ‘খানজাহান আলী বিমানবন্দর’ নামে এর নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪৫ কোটি টাকা। এ সম্পর্কিত প্রকল্পটি আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৬ সালে রামপাল উপজেলায় এ বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা জটিলতায় তা বন্ধ হয়ে যায়। এই দীর্ঘ সময়েও এর কোনো গতি হয়নি। ২০১০ সালে খুলনা সফরকালে খানজাহান আলী বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে (জিওবি) বরাদ্দ দেয়া হবে ৪৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা আর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) দেবে ৫৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিমান ওঠানামার ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পাদনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাণিজ্য সম্প্রসারণে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে খুলনায় কোনো বিমানবন্দর নেই। খুলনা থেকে যশোর বিমানবন্দরের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার, সড়কপথে যা ২ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দরটি স্থাপিত হলে খুলনা ও মংলা বন্দর থেকে দূরত্ব হবে মাত্র ২০ কিলোমিটার। এই অঞ্চলে মংলা বন্দর, মংলা ইকোনমিক জোন, ইপিজেড ছাড়াও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এছাড়া খুলনায় রয়েছে খানজাহান আলীর মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদ। এজন্য ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, পর্যটনশিল্পের প্রসার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনে বিমানবন্দরটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
কমিশন বলছে, সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিমান যোগাযোগে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই নতুন এয়ারপোর্ট নির্মাণ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ১৬৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, ৭২ হাজার ১৭৩ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন করা হবে। একই সঙ্গে বন্দরটির জন্য রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে ও এপ্রোনের জন্য পেভমেন্ট ওয়ার্ক হবে ২ লাখ ৪ হাজার ১৫৩ বর্গমিটার, অপারেশনাল ও আবাসিক ভবন নির্মাণ হবে ১৮ হাজার ৫৬৪ বর্গমিটার, ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল, নেভ এইড এবং ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ ও স্থাপন করা হবে।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য একনেক অনুমোদন দেয়। এ বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে রূপান্তরের জন্য ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি পৃথক পিপি প্রণয়ন করে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় বৈদেশিক অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৬ সালে প্রকল্প সংশোধন নয়, নতুন প্রকল্প হিসেবে প্রস্তাব প্রেরণের জন্য পরিকল্পনা কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রায় ৭ বছর পর ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় পূর্বের ব্যয় ৩২২ কোটি টাকার পরিবর্তে নতুন করে ৪৫৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়। সর্বশেষ খানজাহান আলী বিমানবন্দর প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর ৫ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের। চার শতাধিক রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ৩০ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণ, দেশীয় ও পরিযায়ী মিলে প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৩৩০ প্রজাতির গাছপালাসহ অসংখ্য পশুপাখি ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ আছে। সুন্দরবনের টাইগার পয়েন্টে কচিখালি সমুদ্রসৈকতে বসে সূর্যের উদয় ও অস্ত দেখার রয়েছে অপূর্ব সুযোগ। এ বন ২৪ ঘণ্টায় ছয়বার তার রূপ বদলায়। এজন্য ইকো-ট্যুরিজমপিপাসু পর্যটকরা এ দৃশ্য দেখতে সুন্দরবনে আসেন। প্রতিবছরই সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক লাখ ১৭ হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণে যান এক লাখ ৪০ হাজার ৩৭ পর্যটক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে টানা হরতাল-অবরোধেও পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৫৪০ জনে। তাছাড়া এ এলাকায় রয়েছে হযরত খানজাহান আলী (র.) মাজার, ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ, পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের মাজার ও স্মৃতিসৌধ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের বাসস্থান পিঠাভোগ এবং দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয় ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থান। তবে এ এলাকায় পর্যটক আগমনের প্রধান অন্তরায় যোগাযোগ। বিমানবন্দরটি নির্মিত হলে পর্যটকদের নিরাপদ যাতায়াত সুবিধা হবে এবং পর্যটন খাতের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এসব স্থানে দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে এখানে হোটেল, মোটেল স্থাপন, ট্যুর ব্যবস্থাপনা, ট্যুর গাইডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সূচনা হবে।
অপরদিকে, রপ্তানিকারকরা জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য চিংড়ির প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ সরাসরি খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে রপ্তানি হয়ে থাকে। রেণুপোনা কক্সবাজার হতে খুলনায় সড়কপথে পরিবহন সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাছাড়া চিংড়িসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন। বিমানবন্দর নির্মিত হলে দেশের চিংড়ি রপ্তানি সহজতর হবে ও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। তারা জানান, ১৯৭২ সালে ২০ কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি দিয়ে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে তা প্রায় ৫ হাজার কোটিতে পেঁৗছেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চিংড়ি রপ্তানি হয় চার হাজার ২৪২ কোটি টাকার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার নয় শ’ কোটিতে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে এসব এলাকায় চিংড়ির চাষ বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে রপ্তানিও।