মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রলোভন: যেভাবে থাই জঙ্গলে নিঃশেষ হয় বাংলাদেশিদের স্বপ্ন

123জোবায়ের আহম্মেদ অভি: দারিদ্র্যের কষাঘাত আর জীবিকার টানে প্রায়ই মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান বাংলাদেশিরা। অনেকেই এর জন্য বেচে নেন অবৈধ পন্থা। আর সে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। মানবপাচারকারীদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হয় এসব মানুষকে। ভয়াল সে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জীবনও হারিয়েছেন অনেকে। আর তার প্রমাণ সম্প্রতি থাইল্যান্ডের মালয়েশীয় সীমান্ত এলাকার কাছের একটি জঙ্গলে মানব পাচার শিবির আর গণকবরের সন্ধান লাভের ঘটনা।

গণকবর থেকে উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর বেশিরভাগই বাংলাদেশি আর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বলে ধারণা করা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এভাবে মানব পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের পরিণতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয় মেইল অনলাইন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে আধুনিক যুগের ক্রীতদাস বাণিজ্যের শিকার হতে হচ্ছে লাখ লাখ বাংলাদেশিকে।

মালয় মেইল অনলাইন জানায়, গেল আট বছর ধরে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মুক্তিপণের দাবিতে এ পর্যন্ত অন্তত আড়াই লাখ বাংলাদেশিকে আটকে রাখা হয়। আটককৃত প্রত্যেকের জন্য ২ লাখ থেকে শুরু করে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করা হত। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানায়, বছরের আট মাস কিংবা এর কাছাকাছি সময় পর্যন্ত সপ্তাহে ১ হাজার বাংলাদেশিকে পাচার করে থাকে ওই মানব পাচারকারী চক্র। আর বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার। প্রতিজন অপহৃতের কাছ থেকে গড়ে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসেব করে রয়টার্স জানায়, মানব পাচারকারীরা ওই সময়ের মধ্যে অন্তত ৬৪০ মিলিয়ন টাকা আয় করেছে।মানব পাচার নিয়ে রয়টার্সের বিশ্লেষণও উল্লেখ করেছে মালয় মেইল অনলাইন। গেল বছরের জানুয়ারিতে পাচারকারীদের কাছ থেকে জুয়েল বড়ুয়া নামে ২২ বছর বয়সী এক তরুণকে উদ্ধার করে থাই কর্তৃপক্ষ। সেসময় উদ্ধার হওয়া ওই তরুণের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানায়, পাচারের সময় অভিবাসীদের পিক আপ ট্রাকের পেছনে বসিয়ে প্লাস্টিকে ঢেকে রাখা হয়। তারপর তাদের এমনভাবে পাচার করা হয় যেন ওই ট্রাকে করে সবজি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সীমানা দিয়ে পার হওয়ার পর মালয়েশিয়ায় স্থাপিত রিসিভ হাউজে রাখা হয় অপহৃতদের। মুক্তিপণ পাওয়ার পর কাউকে কাউকে মুক্তি দেয়া হলেও সবার সে সৌভাগ্য হয় না। মুক্তিপণ দেয়ার পরও পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার হননি এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

মানব পাচারের শিকার হওয়ার পর বেঁচে আসা মানুষদের বরাতে রয়টার্স জানায়, পাচারের পর আটক হওয়া এড়াতে অনবরত ক্যাম্প পাল্টাতে থাকে পাচারকারীরা। প্রবাসী থেকে দালালে পরিণত হওয়া এক বাংলাদেশির নাম প্রকাশ না করে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ‘মুক্তিপণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মালয়েশিয়ায় পাঠানোর আগে চাকরি সন্ধানকারীদের থাইল্যান্ডে আটকে রাখা হয়। এর আগে অনেক চাকরি সন্ধানকারী টাকা পরিশোদ না করেই পালিয়ে গিয়েছিল। তাই সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবসার জন্যই এ পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়।’

মুক্তিপণ দেয়ার পরও পাচার থেকে বাঁচতে পারেননি এমন মানুষদের একজন নজরুল ইসলাম। তার দাবি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দেয়ার পরও তাকে এক মালয়েশীয় কন্সট্রাকশন সুপারভাইজারের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল।

নজরুল বলেন, ‘পাচার হওয়াদের জন্য পাচারকারীরা চাকরির ব্যবস্থা করবে এমনটা ভাবা মিথ ছাড়া কিছুই নয়। এখনও সাগরপথে মানুষকে পাচার করার জন্য নিয়ে আসা হয়। হয়তো এ মুহূর্তে আমি যখন কথা বলছি তখনও বাংলাদেশের বিশাল সাগর এলাকায় কার্গো জাহাজ ভাসছে আর তাতে অবস্থান করছে পাচারকারীদের কবলে পড়া হতভাগ্য মানুষ।’

মালয় অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল বছর মানব পাচার নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তরফে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে সবচেয়ে নিম্ন ক্যাটাগরি অর্থাৎ টায়ার থ্রিতে নাম ওঠে মালয়েশিয়ার। ওই তালিকায় মালয়েশিয়ার সঙ্গে রয়েছে সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ড, গাম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলার নামও।

ওই প্রতিবেদনে যেসব দেশ মানব পাচারবিরোধী মান বজায় রাখে তাদের টায়ার ওয়ান ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। টায়ার টুতে রাখা হয়েছিল সেসব দেশকে যারা এখনও পুরোপুরি মানব পাচার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি কিন্তু চেষ্টা করছে। আর টায়ার থ্রিতে রাখা হয়েচির সেসব দেশের নাম যারা মানব পাচার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি এবং চেষ্টাও অতটা নেই। টায়ার থ্রিভুক্ত দেশগুলোতে যেকোনসময় অবরোধ আরোপের হুমকি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে টায়ার টুতে অবস্থানকারী দেশগুলো নিজেদের মান উন্নয়নের চেষ্টা করছে কিনা সে ব্যাপাওে পর্যবেক্ষণের জন্য এক মার্কিন আইন চালু করা হয়। দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় মান অর্জন না করতে পারলে ওইসব দেশকে টায়ার থ্রিভুক্ত করারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.