এভিয়েশন নিউজ: দুই মাসের বেশি সময় ধরে খোঁজ নেই মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমানের। সেই সাথে দু’শ’ ঊনচল্লিশ জন যাত্রীও উধাও। বিমানের যাত্রী ও পাইলট উভয়ের আতঙ্কের এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ঐ বিমান নিখোঁজের পর আকাশ পথ যেন এখন মহা আতঙ্কের নাম। বিমানে চড়ার আগে স্বজনদের কাছ থেকে অনেকেই এখন নিচ্ছেন চিরবিদায়, যেন আর কোনদিন দেখা হবে না। ফ্লাইটে উঠলেই মনে হয়, এই বুঝি বিমানটি তার গতিপথ পরিবর্তন করলো। যাত্রীদের কেউ সিট থেকে উঠলেই ভাবনা জাগে, দূরভিসন্ধি কী! হাতে ওটা কী! সবার চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। চেহারা সুরত, পোশাক-আষাক যাই হোক না কেন, কাউকে বিশ্বাস নেই। সামনে পড়লেই আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে বার বার। এমন আতঙ্ক থেকে মুক্তি নেই পাইলটদেরও। কোথাও কোনো গণ্ডগোল মনে হলে কোন কথাই নেই। সোজা ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং। মানে বিমানটিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কোথাও জরুরি অবতরণ করে প্রাণে রক্ষা।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে কাঠমান্ডু যাবার কথা ছিল নেপাল এয়ারলাইন্সের। ৭০ জন যাত্রী নিয়ে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দর থেকে সুন্দর মতোই উড্ডয়ন করলো বোয়িং-৭৫৭। কিন্তু হঠাত্ পাইলট এম এল শ্রেষ্ঠর কোথায় যেন ঝামেলা মনে হলো। দ্রুত ইউ-টার্ন নিয়ে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। উড্ডয়নের আধা ঘণ্টার মধ্যেই কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে জরুরি অবতরণ। ওদিকে যাত্রীদের মধ্যে তো ভয় আর আতঙ্কে কাঠ হবার জোগাড়। পরে পাইলট জানান, উড্ডয়নের পর বিমানের ডান ইঞ্জিনের পাখায় সমস্যা মনে হওয়ায় তিনি আর কোনো ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে সোজা জরুরি অবতরণ করেন। ইঞ্জিন কাঁপাকাঁপি করছিল। বোঝাই যাচ্ছিল কোনো সমস্যা। তাই নিখোঁজ হবার ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী!
মালয়েশিয়ার বিমান নিখোঁজের তিনদিন পরের কথা। ঐ বিমানের যাত্রীদের ভাগ্য নিয়ে তখন উত্কণ্ঠায় দুনিয়ার সবাই। এটা ছিনতাই, নাকি আত্মঘাতি, এ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা বিশ্লেষণ। এ সবের মধ্যেই ইউএস এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটের পাইলটরা যাত্রী কেবিনে হঠাত্ চিত্কার আর হইহুল্লা আঁচ করেন। সাথে সাথে বিপদে পড়ার সংকেত পাঠাতে থাকেন পাইলট। যাত্রী কেবিনে তখন চলছে সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। এক শিশুর দম বন্ধ হয়ে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে না। চিত্কার করে কান্না জুড়ে দিয়েছে তার মা। চোখের সামনে নিষ্পাপ শিশুকে নীল হতে দেখে সবাই স্তম্ভিত। এ সময় এগিয়ে আসেন প্যারামেডিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই যাত্রী। এরই মধ্যে হাস্টনে জরুরি অবতরণ করেছে বিমানটি। বিমান বন্দর ঘিরে ফেলেছেন নিরাপত্তা আর তদন্ত কর্মীরা। বিমানের ভেতরে ঢুকে তারা সবাইকে দেখতে পান অশ্রুসজল। আনন্দের অশ্রু। সবার নিরবতা ছাপিয়ে কেবল চিত্কার জুড়ে দিয়ে কাঁদছে এক শিশু। ফ্লোরিডার টাম্পা বিমান বন্দর থেকে আরিজোনার ফোনিক্স স্কাই হারবার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামার কথা ছিল সবার।
এবার মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স। আতঙ্ক যেন সবচেয়ে বেশি পেয়ে বসেছে তাকে। গত ২০ এপ্রিল নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের ভাবমূর্তির উপর আরেকটা চপেটাঘাত দেয় ফ্লাইট এমএইচ-১৯২। এবার ১৬৬ জনকে নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালুরু রওনা হবার পরপরই ঠুস করে কিছু একটা শব্দ পান বিমানের পাইলট। আর কোন কথা নেই। সাথে সাথে কুয়ালালামপুরের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন বিমান। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্বদেশি নিখোঁজ বিমানটির চিত্র। পরে দেখা যায়, বিমানের একটি চাকা ফেটে গেছে। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘নিরাপত্তা আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার বিষয়। এ কারণেই বিমানটি ফিরে এসে ভালোই করেছে। আর টুইটারে মালয়েশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী জানান, ‘থ্যাঙ্ক গড- ওরা নিরাপদে অবতরণ করেছে’। পরে রানওয়ে থেকে উদ্ধার করা হয়, ফেটে যাওয়া চাকার অংশ।
গত ৭ এপ্রিলের কথা। বোয়িং বিমানকে জরুরি অবতরণে বাধ্য করে একপাল গরু। উন্নত জাতের প্রায় চারশ’ গরু নিয়ে আইরিশ সাগরে পাড়ি দেয়ার সময় অটো ফায়ার অ্যালার্ম বাজে ককপিটে। পাইলট ধরেই নেন বিমানে আগুন লেগেছে। সাহায্যের জন্য বিপদের সংকেত পাঠান তিনি। লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দর জরুরি অবতরণের অনুমতি দেয়। আগুন নেভাতে ব্যাপক আয়োজন নেয়া হয়। কিন্তু, একি, বিমানে আগুন তো দূরের কথা, কোনো ধরনের ধোঁয়ার কুণ্ডলী পর্যন্ত নেই। হতাশ হয় দমকল কর্মীরা। পরে বিশেষজ্ঞরা জানান, এর জন্য দায়ী গরু। সাধারণ মানুষের চেয়ে অতিরিক্ত উত্তাপ আর মিথেন গ্যাস ছড়ায় তারা। আর এ কারণেই বেজেছে ফায়ার অ্যালার্ম। পরদিন লন্ডনের সব পত্র-পত্রিকায় মজা করে আসে সেই খবর।
এমনই অদ্ভুতুড়ে সব কাহিনী ঘটছে আকাশপথ ঘিরে। যুক্তরাজ্যের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দিনে গড়ে তিনটি এমন বিপদ সংকেত পাচ্ছে তারা। এই সব সংকেতকে আবার বিমানের ভাষায় দুই নামে ডাকা হয়। সত্যিকার বিপদ সংকেতকে বলা হয়, মে-ডে কল। আর আলতু ফালতু কম গুরুত্বপূর্ণ সংকেতকে ডাকা হয়, প্যান-প্যান কল। তবে পাইলটরা সবচেয়ে বেশি ভয় পান খারাপ আবহাওয়াকে। এ কারণে গত ২৯ এপ্রিল ইন্ডিয়ানাপোলিস আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নিরাপদ জরুরি অবতরণ করে চারটি বিমান। আর দুর্যোগ টের পেয়ে ঐ দিন গতিপথ পরিবর্তন করে শিকাগোর ১৩টি ফ্লাইট। এদিকে, মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমানের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা এখনও শেষ হয়নি।
সম্প্রতি ক্রিস গুডফেলো নামে কানাডার একজন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ সবার নজর কাড়ে। সেদেশের ক্লাস ওয়ান পাইলট হিসেবে বিশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে গুডফেলোর। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার নিখোঁজ ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিয়ে অনেক ভুল থিওরি মানতে বিশ্ববাসীকে বাধ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিমানটি ছিনতাই বা সন্ত্রাসের শিকার হয়ে উল্কার মতো সমুদ্রে পড়েছে। কিন্তু সহজ কথাটি বলা হয়নি কখনই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে গুডফেলো বলেন, কোনোভাবে আগুন লেগে বিমান তার সিগন্যাল পাঠানোর ক্ষমতা হারায়। পাইলট বিপদ সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কাছাকাছি কোনো বিমান বন্দরে যাবার সময় বিমানটি ভারত মহাসাগর বা অন্য কোথাও বিধ্বস্ত হয়। একারণে ঝড়ো বাতাসে বিমান যদি একটু হেলে-দুলে ওঠে তবে অনেকে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ শুরু করে ভাবছেন, নিচে মহাসাগর নয় তো!
– বরকতুল্লাহ সুজন