বড় ঋণ জালিয়াতরা টাকা দিচ্ছে না

বড় ধরনের জালিয়াতি করে যেসব গ্রাহক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে কোনো অর্থই আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। জালিয়াতি করে নেয়া সব ঋণই ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এগুলোর বেশির ভাগ আবার পরিণত হয়েছে আদায় অযোগ্য কুঋণে। এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রায় দ্বিগুণ টাকা আটকে গেছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া এসব আমানতের বিপরীতে নিয়মিত মূল টাকাসহ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

এছাড়া ঋণ ব্যবস্থাপনা, আইনি লড়াই চালানো ও জামানত পাহারা দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে আরও অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি এখন ব্যাংকের জন্য বড় বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোতে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে হলমার্ক গ্রুপের নামে সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, একই বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকসহ একটি সরকারি ব্যাংক থেকে সানমুন গ্রুপ ১ হাজার ৬০০ টাকা, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফার্মার্স ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জনতা ক্রিসেন্ট লেদারের নামে ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নেয়। এছাড়া চট্টগ্রামের সোনালী ব্যাংকের লালদীঘি শাখা, বেসরকারি খাতের শাহজালাল ব্যাংকসহ নতুন প্রজন্মের কয়েকটি ব্যাংকে আরও কিছু জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে যেসব জালজালিয়াতি হয়েছে সেগুলোর আদায় করা এখন সম্ভব নয়। জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে জড়িত ব্যাংকারদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। ফলে নতুন জালিয়াতি বন্ধ হবে। তখন ঘটে যাওয়া জালিয়াতির টাকা নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা যাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জালিয়াতি হওয়া কোনো ঋণের টাকা আদায় হয়নি।

ব্যাংকগুলোতে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায় করতে পারছে না। প্রতি মাসে ১ কোটি টাকা করে ঋণ শোধের শর্তে হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তিনি ঋণের টাকা শোধ করতে না পারার কারণে আবার জেলহাজতে ঢুকেছেন। এখন হলমার্কের সব কারখানা বন্ধ। সাভারের জমি ও কারখানার সম্পদ রক্ষার্থে সোনালী ব্যাংক আনসার নিয়োগ করেছে।

এখন সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে হলমার্ক গ্রুপ। এ ঘটনায় হলমার্কের এমডি তানভির মাহমুদসহ হলমার্ক ও ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জেলে রয়েছেন। হলমার্কের জালিয়াতির একটি অংশ সোনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

বিসমিল্লাহ গ্রুপ ঋণের নামে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ওই অর্থ এখন ব্যাংকগুলো আদায় করতে পারছে না।

বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে এখন আদায় বলতে নেই। কিছু ঋণ গ্রাহকদের খুঁজে বের করে নবায়ন করেছে ব্যাংক। এগুলো এখন আবার খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এই জালিয়াতির প্রক্রিয়ায় পণ্য আমদানির নামে দেশ থেকে ১৭৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে সব মিলে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সব ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ দেয়া হচ্ছে না তাদের। এতে এখন গ্রুপটি ব্যবসা চালাতে পারছে না। ফলে তাদের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এদিকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক তদন্তে ক্রিসেন্ট গ্রুপের পণ্য রফতানির মূল্য দেশে না এনে দেড় হাজার কোটি টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে।

সানমুন স্টার গ্রুপের সব ব্যবসা এখন বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটির মালিকও এখন জেলে। ফলে ইতিমধ্যেই তাদের সব ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ওইসব ঋণ এখন আর আদায় হচ্ছে না।

ফার্মার্স ব্যাংক জালিয়াতি করে বের করে নেয়া ঋণ এখন আদায় করতে পারছে না। অন্যান্য ঋণও আদায় কম। ফলে ব্যাংকটি প্রকট তারল্য সংকটে পড়ে। এই সংকট কাটাতে সরকার ব্যাংকটিকে উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ৭১৫ কোটি টাকা দিয়েছে। আরও টাকা চাচ্ছে তারা। এতেও ব্যাংকটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালু করতে পারছে না।

কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জালিয়াতি ধরা পড়ার পর তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে গ্রাহককে ঋণখেলাপি করেছেন। গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এতে গ্রাহক জেলে গেছেন, কেউ পালিয়ে গেছেন। এ কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধের পথে। ফলে ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না।

তারা জানান, জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত গ্রাহকদের ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে এনে নতুন ঋণ দিয়ে ব্যবসা চালু রাখা সম্ভব হলে ঋণ আদায় করা যেত। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে না বলে মনে করে ব্যাংকাররা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে ঋণ শ্রেণী খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সেগুলো আদায় করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এর আলোকে ব্যাংকগুলো কাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে কোনো অঘটন ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।

এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ আদায় না হওয়ায় সেগুলো খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারি ব্যাংকগুলোকে দেয়া জনগণের করের অর্থ থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। গত অর্থবছর পর্যন্ত ৬টি সরকারি ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি বাবদ দেয়া হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের এসব অর্থের সংস্থান থেকে সেখান থেকে এসব অর্থ দেয়া হচ্ছে।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ১০টি জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংকিং খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যাংকিং খাত তরল্য সংকটে ভুগছে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.