চড়া সুদে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ

চড়া সুদে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ।

চড়া সুদের বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে থাকছে অধিক শর্তও। আগে যেসব উন্নয়নসহযোগী সংস্থার কাছ থেকে সুদবিহীন কিংবা নামমাত্র সুদে ঋণ পাওয়া যেত এখন সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিুমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি বিবেচনায় সস্তা ঋণ পাওয়া থেকে বাদ পড়ছে দেশ। তাছাড়া আগে থেকেই কমে গেছে অনুদান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইআরডি’র সচিব মনোয়ার আহমেদ বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে গেলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। বিশ্বব্যাংক এবং জাইকার ঋণের সুদের হার কিছুটা বাড়ালেও চীন, রাশিয়া এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে যেসব ঋণ নেয়া হচ্ছে সেগুলোর সুদের হার আপাতত বাড়ছে না।
তবে সুদবিহীন বা স্বল্প সুদের ঋণ কমছে। কিন্তু অন্যান্য ঋণের সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে প্রথাগত উন্নয়নসহযোগীর বাইরেও বিভিন্ন নতুন নতুন উন্নয়নসহযোগী সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া যাবে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অনুদান কমে যাওয়া, ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

সূত্র জানায়, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে প্রাপ্ত বিদেশি সহায়তার ৮৬ শতাংশ অর্থ এসেছিল দ্বিপক্ষীয়ভাবে। এসব সহায়তার সিংহভাগই ছিল অনুদান। ঋণ হিসেবে আসা দ্বিপক্ষীয় সহায়তার সুদের হার ছিল বেশি। পরিশোধের সময়ও ছিল কম। রাষ্ট্র খাতের কল-কারখানা সচল রাখা ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো তৈরির জন্য বাংলাদেশের হাতে তখন বিকল্প ছিল না। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক অর্থ সহায়তার মাত্র ১৪ শতাংশ পাওয়া গিয়েছিল বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে। এরপর ১৯৭২-৭৩ সময়ে বৈদেশিক সহায়তার ৩৮ শতাংশ এসেছিল খাদ্য বাবদ, প্রায় ৫২ শতাংশ উপকরণ ও মাত্র ১০ শতাংশ উন্নয়ন প্রকল্পে। সহায়তার ৮৯ শতাংশ ছিল অনুদান আর ১১ শতাংশ ছিল ঋণ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বৈদেশিক সহায়তার ৬৪ শতাংশ ঋণ, অনুদান এসেছিল ৩৫ শতাংশের কিছু বেশি। প্রকল্প সহায়তা বাবদ এসেছে ৯৯ শতাংশ অর্থ, খাদ্য সহায়তা ১ শতাংশের মতো। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছাড় হওয়া বিদেশি সহায়তার ৯৯ দশমিক ২০ শতাংশই এসেছে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে। এর মধ্যে ঋণ ছিল ৮৭ শতাংশ। আর অনুদান ছিল মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ।
ইআরডি সূত্র জানায়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ঋণের কঠিন শর্ত ও উচ্চ সুদ কার্যকর করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি সুদের হার শূন্য থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কার্যকর করেছে। এর সঙ্গে আগে থেকে অব্যাহত থাকা সার্ভিস চার্জ দশমিক ৭৫ শতাংশ বলবৎ রয়েছে। তাই সব মিলিয়ে এখন সুদের হার দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। প্রথমবারের মতো ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাভলিহুডস (সুফল)’ প্রকল্পের মাধ্যমে এ সুদ হার কার্যকর হয়। এছাড়া ঋণ পরিশোধের সময়ও কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অর্থাৎ আগে আইডিএ তহবিল থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে সময় পাওয়া যেত ৩৮ বছর।
এখন ৮ বছর কমিয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। অন্যদিকে আগে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ৬ বছরের গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) ছিল। কিন্তু এখন এক বছর কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সব দিক দিয়েই বিশ্বব্যাংকের ঋণে শর্ত কঠিন করা হয়েছে। এর যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৭- এই তিন বছর মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অর্জন করায় ‘গ্যাপ কান্ট্রি’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। তাই সস্তা ঋণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো দেশ এ অবস্থানে থাকলে সস্তা ঋণের সুবিধা আর পায় না।
ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এর আগে যুগান্তরকে বলেন, গ্যাপ কান্ট্রি অর্থ হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (আইডিএ) থেকে ঋণ পাওয়ার একটি থ্রেসহোল্ড বা মাপকাঠি। যখন কোনো দেশ পর পর ১ হাজার ১৬৫ ডলার জাতীয় মাথাপিছু আয় অব্যাহ রাখে তখন সেই দেশ এই গ্যাপ কান্ট্রি হিসেবে বিবেচিত হয়। তখন সার্ভিস চার্জের সঙ্গে সুদের হার যুক্ত হয়। তবে এই সুদ হার অন্যান্য দেশ বা সংস্থার চেয়ে বেশি নয়। এটি প্রতিযোগিতামূলক থাকে।
অন্যদিকে সস্তায় ঋণ পাওয়ার আর একটি অন্যতম উৎস ছিল জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। সংস্থাটির কাছ থেকে বার্ষিক শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ সুদ হারে ঋণ পেত বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ১০ বছরের রেয়াতকালসহ ৪০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি সময়ে এই ঋণ পরিশোধের সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন সুদ হার বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ করেছে জাইকা। তাছাড়া পরিশোধের ক্ষেত্রে রেয়াতকাল ঠিক থাকলেও পরিশোধের সময় ১০ বছর কমিয়ে করা হয়েছে ৩০ বছর। এভাবে সস্তা ঋণ কমে যাওয়ায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বেশি সুদ বা শর্তযুক্ত ঋণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে সরকারকে। বেশি সুদ ও শর্তযুক্ত ঋণ যেসব দেশ থেকে নেয়া হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- চীন, রাশিয়া, ভারত, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ইত্যাদি। তবে বেশি সুদে ঋণ নিলেও তা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে মনে করছে ইআরডি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যেকোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশের নিচে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.