সুদের হার না কমলে বাড়বে না বিনিয়োগ।
বর্তমানে ঋণের সুদ হার যে অবস্থায় আছে, তাতে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। সুদ হার না কমলে বিনিয়োগ বাড়বে না। শিল্প ঋণের সুদ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। এরপর রয়েছে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ। এ হারে সুদ দিয়ে কেউ বিনিয়োগে আসবে না। কারণ কোনো ব্যবসায় এ হারে লাভ হয় না।
ঘোষিত মুদ্রানীতি নিয়ে আলাপকালে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা এসব কথা বলেন।
বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমানো হয়েছে। বিপরীতে বেড়েছে সরকারি ঋণের লক্ষ্য। অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মুদ্রানীতির লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ। কারণ গত ৬ মাসে যে মুদ্রানীতি ছিল, তার বাস্তবায়ন হার খুবই কম। বিশেষজ্ঞদের
কয়েকজন বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী দেশে বেসরকারি বিনিয়োগকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে চান, সেখানে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম টেনে ধরা বিনিয়োগ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ নীতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ কমিয়ে দেবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, মুদ্রানীতি হল আগামীতে মুদ্রার সরবরাহ কেমন থাকবে, তার একটি রূপরেখা। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের কর্মসংস্থান ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না।
তিনি বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে উল্লেখ করার মতো নতুন কিছু নেই। লক্ষ্যমাত্রায় দু-একটি বিষয়ে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ শমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটি তেমন কিছু নয়।
তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে আগামীতে এ ১৬ দশমিক ৫ শতাংশই বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ বর্তমানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম। এর মূল কারণ বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ নেই।
তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু লক্ষ্যমাত্রা ধরলেই ঋণ বাড়বে না। এর ঋণ ব্যবহারের পরিবেশ লাগবে। এজন্য বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু টাকা থাকলেই মানুষ বিনিয়োগ করে না। এজন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। এর মধ্যে অবকাঠামো সুবিধা, সুশাসন নিশ্চিত করা অন্যতম।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে এর অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে। সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, প্রথমার্ধে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়নি। এ সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সুদ বেশি পাওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক থেকে তেমন ঋণ সরকার নেবে বলে মনে হয় না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বর্তমানে ঋণের সুদ ১৪-১৫ শতাংশ। এ হারে সুদ দিয়ে কে ঋণ নেবে। কারণ কোনো ব্যবসায় এ পরিমাণ লাভ নেই।
তিনি বলেন, শুধু ঋণ নিলেই হবে না। এ ঋণ দিয়ে ব্যবসা করে ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিতে চায়। আর বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
তার মতে, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হল বেসরকারি খাত। আর এ খাতকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানোসহ ব্যবসার ব্যয় কমাতে হবে। খেলাপি ঋণ কমানো ও টাকা পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন তিনি।
এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, যারা ঋণের নামে লুটপাট করেছে, দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে টাকা নিয়ে গেছে, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দ্রুত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ঋণের হার বাড়ানোর চেয়েও ঋণের সুদ কমানো জরুরি। তিনি বলেন, সুদের হার কমিয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ঋণের চাহিদা বাড়ানো জরুরি। কারণ অধিক সুদে কেউ ঋণ নিতে চাইছে না।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত সুদের হার কমানোর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। প্রধানমন্ত্রী সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে ব্যাংক ঋণে একটি ভারসাম্য আনা জরুরি।
জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, ঋণ বিতরণের লক্ষ্য কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো একটু কঠিন।
তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি আছে। এ কারণে সরকারি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। এর মানে দাঁড়ায় সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে। এ অবস্থা ঋণের চাহিদা বাড়বে। তারল্য সংকট সৃষ্টি হাতে পারে। যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করবে। তবে অন্য একটি সূত্র রয়েছে। যেমন বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ দুটি মিলে হয় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্য বেশি। ফলে এটি আশঙ্কাজনক নয়। এছাড়াও আগের ৬ মাসে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সবকিছু মিলে মুদ্রনীতিতে ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।