টেন্ডার ছাড়া ২ এয়ারক্রাফটের লীজ নিয়ে বিমানের কেলেঙ্কারি!

Biman-Bangladeshএভিয়েশন নিউজ: আবারো উড়োজাহাজ লীজ কেলেঙ্কারিতে বিমান! জান গেছে বিমান বোর্ডে বাতিল হওয়া ২টি উড়োজাহাজ লীজ সংক্রান্ত ৫শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ফের এজেন্ডায় আনা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ মাসে দরপত্র ছাড়াই অতিগোপনে দুটি পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজের লিজ চুক্তির মেয়াদ ৬ বছর বাড়ানোর একটি প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদের ১২৭তম সভায় বাতিল করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের টাকা ফেরত দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। শুধু তাই নয়, বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজ লীজদাতা কোম্পানী জিকাসকে জানিয়েও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই একই প্রস্তাবনা ঘষামাজা করে আবারো বোর্ড সাব কমিটির সভায় পুনর্বিবেচনার জন্য এজেন্ডায় রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, একজন প্রভাবশালী বোর্ড মেম্বারের অতি উৎসাহের কারণে এটিকে আবারো সামনে আনা হয়েছে। এর নেপথ্যে বড় ধরনের রহস্য লুকিয়ে আছে।

অভিযোগ পরিচালনা পর্ষদের গত সভায় হজ যাত্রী পরিবহনের জন্য বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এর রিপ্লে­সমেন্ট হিসাবে একটি বোয়িং ৭৬৭ এয়ারক্রাফট না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অভিযোগ ওই এয়ারক্রাফট নেয়ার পক্ষে বোর্ডের একজন প্রভাবশালী সদস্য প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি একটি গুরুত্বপুর্ণ বোর্ড সাব কমিটির চেয়ারম্যানও। কিন্তু অন্যান্যরা এর বিরোধীতা করলে সেটা নেয়া সম্ভব হয়নি। জানাগেছে ওই বোর্ড মেম্বর এরপর জিকাসের উড়োজাহাজ দুটি আরো ৬ বছর বিমানে রাখার পক্ষে অবস্থান নেন। জানাগেছে, এটা বাস্তবায়ন করা হলে বিমান ৫শ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিমানের সাবেক বিদেশী এমডি কেভিন জন স্টিল সম্প্রতি পগত্যাগ করেছেন। এরপরই তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক এম মোসাদিক আহমেদকে। অভিযোগ উঠেছে কেভিন স্টিলের পদত্যাগের পর বর্তমানে বিমানের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। যে যেভাবে পারছে এখন আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একাজে পরিচালণা পর্যদের কতিপয় সদস্যও পিছিয়ে নেয়।

এদিকে মঙ্গলবার পরিচালণা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন আহম্মেদ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন। একারণে বিমান এমডিসহ কোন শীর্ষ কর্মকর্তাই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে পরিকল্পনা বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন পুর্বের প্রস্তাবটি পরিচালণা পর্যদ সভায় সর্বসম্মতক্রমে বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, জিকাসের পাঠানো বর্তমান প্রস্তাবপি সম্পুর্ণ নতুন। জানাগেছে পরিচালনা পর্যদের ওই সভায় বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেভিন স্টিল ও বোর্ডের সকল সদস্য একযোগে এর (এজেন্ডা-৬) বিরোধীতা করেছিলেন। বলা হয়েছিল প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বিনা টেন্ডারে দীর্ঘ সময়ের জন্য বর্ধিতকরণ কোনভাবেই সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, গত ৯ মার্চ এশটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ‘গোপনে লীজ চুক্তির মেয়াদ ৬ বছর বাড়ানোর পায়তারা’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, অতিগোপনে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের নেপথ্যে ৫০ থেকে ১শ’ কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ওই পত্রিকার রিপোর্টটি নিয়ে পরিচালণা পর্যদের সভায়ও চুল ছেঁড়া বিশ্লেষন হয়। এরপর প্রস্তবনাটি বাতিল করে দেয়া হয়।

বিমানের পরিকল্পনা বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ফেব্রয়ারি মাসে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ ৫ বছরের জন্য লিজ নেয় বিমান। উড়োজাহাজ দুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। নিয়ম হল, লিজ চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে এক বছর আগে সংশ্লিষ্ট লিজদাতা কোম্পানিকে তাদের উড়োজাহাজ দুটি রাখবে কি রাখবে না সেটা জানিয়ে দিতে হয়। এ কারণে বিমানের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট কাউকে না জানিয়ে গোপনে উড়োজাহাজ দুটির লিজ মেয়াদ আরও ৬ বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাবনা তৈরি কওে বোর্ড সাব কমিটিতে প্রেরণ করে। বোর্ড সাব কমিটি সেটা সুপারিশ আকারে পুর্ণাঙ্গ বোর্ড সভায় পাঠায়।

নিয়ম অনুযায়ী বিমানের যে কোনো কেনাকাটা, এয়ারক্রাফট লিজ, জিএসএ নিয়োগ চুক্তি ও চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে আরএফপি করতে হবে। টেন্ডার ছাড়া কোনো চুক্তি নবায়ন, চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম। বিশেষ করে উড়োজাহাজ লিজ মেয়াদ বাড়ানোর কোনোই সুযোগ নেই। এর আগেও বিনা টেন্ডারে এফ-২/এডিএইচ মডেলের একটি এয়ারবাসের লিজ চুক্তির মেয়াদ ৪ বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও বিমান বোর্ড তা নাকচ করে দেয়। ওই বোর্ড সভায়ও দরপত্র ছাড়া কোন উড়োজাহাজের লীজ মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নেন সব সদস্য।

বিমান বোর্ড সদস্য বিচারপতি মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ কিছুদিন আগে সাংবাকিদের বলেছেন, বর্তমানে বহরে থাকা উড়োজাহাজ দুটির (৭৩৭-৮০০) লীজ মেয়াদ যদি না বাড়ানো হয়, তাহলে রি-ডেলিভারি পেমেন্ট বাবদ লিজদাতা প্রতিষ্ঠান ‘জিকাস’কে ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হবে। তাছাড়া মেইনটেনেন্স রিজার্ভও প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার হবে। তারপরও তিনি বলেন, টেন্ডার ছাড়া এত বড় একটি প্রকল্প অনুমোদন ঠিক হবে না। দুদকে প্রশ্ন উঠতে পারে। মামলা হতে পারে।

কেভিন স্টিল বিমানের এমডি থাকাকালীন সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মেয়াদ শেষে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ দুটি আর বহরে রাখা হবে না। কারণ ১৫-২০ বছরের পুরনো বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি মাসে গড়ে দু-একবার এসব এয়ারক্রাফট যান্ত্রিক সমস্যায় পড়ে। এতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেড়ে যায়। শুধুমাত্র এই কারণে বিমান তাদের বহরে থাকা ডিসি-১০ উড়োজাহাজ ফেইজ আউট (বহর থেকে বাদ) করে দেয়। কিন্তু দুনীতিবাজ সিন্ডিকেট ও অধন্তজাতিক মাফিয়া চক্র উড়োজাহাজ মেরামতের নামে শত শথ কোটি টাকা আয় করার টার্গট নিয়ে জিকাসের ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ দুটি আরো ৬ বছর রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে।

বর্তমানে বিমানে মোট ১০টি উড়োজাহাজ আছে। এরমধ্যে ৪টি ব্রান্ড নিউ। বাকী ৬টি পুরনো। আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জিকাসের ১৫ বছরের লক্কড়-ঝক্কড় উড়োজাহাজ দুটি চলে গেলে বিমান ১০ বছর বয়সী দুটি উড়োজাহাজ লীজ নেবে। এতে পুরো বহরটি নতুন হয়ে যাবে। এতে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত নিয়ে শত শত কোটি টাকার যে ‘লুকোচুরি খেলা’ সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। একারণে সিন্ডিকেট বোর্ড মেম্বারদের পর্যন্ত কব্জা করে তাদের মাধ্যমে ব্যবসা হাতিয়ে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ যে কোন বোর্ড মেম্বারের অঙ্গুলির ইশারা ছাড়া পুর্ণাঙ্গ বোর্ড সভায় বাতিল হওয়া একটি প্রস্তাবনা ফের এজেন্ডা আকারে আসা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। বিমান ম্যানেজমেন্টেরও কোন সদস্য এধরনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে না।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.