নৌপথে পাচারকারী চক্রের গোপন প্রতিবেদন : মানবপাচার বাড়ছে আকাশপথে

airlinesমনির হোসেন : মালয়েশিয়াকে টার্গেট করে নৌপথের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আকাশপথে মানবপাচার। প্রতিদিন হজরত শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সি নামধারী ‘ফাইং দালালচক্র’ অসহায় মানুষজনকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে দেশটিতে পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এসব মানুষের কারো ঠিকানা হচ্ছে থাইল্যান্ডের গণকবরে, কারো মালয়েশিয়ার জেলখানাসহ বন-জঙ্গলে।

এ দিকে মালয়েশিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্ট ও ভিজিট ভিসার নামে আশঙ্কাজনকহারে মানবপাচারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সরকারও চক্রের সন্ধানে তৎপর হয়ে ওঠে। নৌপথে মানবপাচারের সাথে কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কোনো কোনো দালালচক্র জড়িত, তাদের নাম পরিচয় উল্লেখ করে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কাছে গোপন প্রতিবেদন দিয়েছে মালয়েশিয়া। ১২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হয় বলে মালয়েশিয়া থেকে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি টাস্কফোর্স থাকলেও তারা বিমানবন্দরকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যেকোনো সময় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে না পারায় ওই চক্র আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর চক্রটিকে নেপথ্যে থেকে দুই বিমানবন্দরের কিছু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা প্রতিটি আদমের কিয়ারেন্স দেয়া বাবদ ৪০-৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে বলে জনশ্রুতি রয়েছে, যার কারণে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়াগামীদের প্রফেশনাল ভিসায় ছাড়পত্র (বহির্গমন) না দিলেও লক্ষাধিক বাংলাদেশী নামধারী শ্রমিক বিমানবন্দর ব্যবহার করেই অনায়াসে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা গতকাল নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, শুধু নৌপথেই মানবপাচার হচ্ছে তা কিন্তু নয় আকাশপথে এর চেয়েও বেশি হচ্ছে। তবে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর থেকে সম্প্রতি অনেক মানুষের লাশ (কংকাল) উদ্ধার হওয়ার পর বিমানবন্দরকেন্দ্রিক আদমপাচার কিছুটা কমেছে।

তিনি বলেন, এর আগে শাহজালাল ও শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে হাজার হাজার ‘পর্যটক’ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফাইটে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। দালালদের সাথে ইমিগ্রেশনের কিছু কর্মকর্তার অলিখিত চুক্তি থাকায় অনেকে ফাইটে উঠতে পারেন। তবে তাদের মধ্যে অনেককেই মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট থেকেই ফিরতি ফাইটে ফেরত পাঠানো হয়। এ সংখ্যা অনেক। তারপরও চক্রটি থেমে নেই। পরবর্তী ফাইটে আবারো তাদের পাঠায়। সফলও হয়। যার কারণে এখন মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ায় মালয়েশিয়া সরকারের নির্দেশে ইমিগ্রেশন, পুলিশ, রেলাবাহিনী প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে। এতে অনেক বাংলাদেশী ধরা পড়ে কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকে পুলিশি অভিযান থেকে বাঁচতে বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, মানবপাচার এখন বিমানবন্দরের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন মালয়েশিয়াগামী ফাইট ঘিরে লাখ লাখ টাকার কমিশন বাণিজ্য হয়। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ‘ফাইং দালালদের’ ভাষ্য মতে, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন থেকে বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত একজন যাত্রীকে পৌঁছে দিতে ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়। এ চুক্তির বাইরে কেউ বিমানে উঠতে পারেন না। তবে শোনা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের গণকবরের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তিন-চার দিন ধরে বিমানবন্দরে কিছুটা কড়াকড়ি চলছে। দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রীদের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না তা যাচাই করছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জাল পাসপোর্টে মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক যাত্রী বিমানবন্দরে ধরা পড়েছেন। এমন এক হাজারের মতো পাসপোর্ট দেশটির ইমিগ্রেশন জব্দ করেছে। এসব যাত্রী বাংলাদেশ ছাড়ার আগে দু’টি পাসপোর্ট সাথে নিয়ে গেছেন। একটিতে শ্রীলঙ্কার ফলস ভিসা লাগিয়ে ঢাকার বিমানবন্দর ত্যাগ করে। অপর পাসপোর্টটি মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে নেমে বের করে। এরপর পকেট থেকে ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে মালয়েশিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে। দালাল চক্রের এমন কৌশলও মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন জেনেছে।manabpacar

এর আগে মালয়েশিয়া থেকে একজন ব্যবসায়ী বলেন, টেকনাফ, কক্সবাজার রুট দিয়ে সাগরপথে কারা কারা মালয়েশিয়ায় ট্রলার ভরে লোক আনছে এমন ১০-১২ পেশাদার আদমপাচারকারী গডফাদারের নামসহ বিস্তারিত তথ্য মালয়েশিয়া সরকার গোপন প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ হাইকমিশনে দিয়েছে। ওই প্রতিবেদন ট্রলারে মালয়েশিয়ায় আসা শ্রমিকদের স্টেটম্যানের ভিত্তিতে করে। দুই দিন আগে প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে মালয়েশিয়া হাইকমিশন থেকে পাঠানো হয়েছে। গোপন প্রতিবেদনে আদমপাচারের সাথে কক্সবাজার থেকে মালয়েশিয়ায় আসতে মোট কতগুলো ঘাট দালালরা ব্যবহার করছে, কারা কার মোবাইলে টাকা লেনদেন করেছে ওই সব নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ চক্রের সাথে জড়িতদের শনাক্ত করে মালয়েশিয়া ও থাই সরকার রিংলিডারদের গ্রেফতার করেছে। এখন আমাদের সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে দেশে থাকা মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা কঠিন হবে না। তিনি বলেন, আমার জানা মতে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি টাস্কফোর্স টিম গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ওই টাস্কফোর্সের সদস্যরা আসলে কি কাজ করছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি না। টাস্কফোর্স যদি তৎপর থাকত তাহলে হাজার হাজার লোক অবৈধভাবে আকাশপথে মালয়েশিয়ায় আসতে পারতেন না। তবে শুধু টাস্কফোর্সকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলেন তিনি।

গত রাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মানবপাচারের বিষয় দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমাদের কাজ হচ্ছে ইলিগ্যাল মাইগ্রেশন হচ্ছে কি না।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.