বৃটিশ দুর্গে হানা দিয়েছেন বাঙালিরা। সেখানকার রাজনীতিতে এরই মধ্যে ভাল একটি স্থান দখল করেছেন বাংলাদেশীরা। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তিনজন। তারা হলেন টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রুপা হক। এর মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। টিউলিপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে। রুশনারা আলী হলেন প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপি। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বেথনাল
গ্রিন অ্যান্ড বো আসন থেকে। অন্যজন ডা. রুপা হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন লেবার পার্টি
থেকে। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে। এর মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিকের বয়স ৩২ বছর। তিনি বসবাস করেন ফিঞ্চলে রোডে। গতকাল যখন নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয় তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সকাল ৫টায়। বিজয় উদযাপন মঞ্চে উঠে তিনি পরিবার ও সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। হ্যাম্পস্টিড অ্যানই কিলবার্ন আসনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের সিমন মারকাস। তার সঙ্গে অল্প ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন টিউলিপ সিদ্দিক। তাদের ভোটের ব্যবধান ১১৩৮টি। টিউলিপ সাবেক ক্যামডেন কাউন্সিলের কেবিনেট সদস্য। তিনি গতকাল যখন বিজয় উদযাপন করতে ঘর থেকে বের হন, সঙ্গে নেন স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পারসি, মা, বোন, ভাই ও সমর্থকদের।
সমারস টাউন কমিউনিটি সেন্টার থেকে যখন তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তখন টিউলিপ বলেন, হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে নির্বাচিত এমপি হিসেবে এ মঞ্চে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে আমি যারপরনাই সম্মানিত বোধ করছি। এ নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। টিউলিপ বলেন, আপনি আমাকে ভোট দিয়ে থাকুন বা আমার প্রতি যদি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন, আপনি যদি বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করে থাকেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার জন্য লিফলেট বিতরণ করে থাকেন, যদি আপনি প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনে আমার জন্য ভোট চেয়ে দরজার কড়া নেড়ে থাকেন- এজন্যই আমি আপনাদের এভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এ সেই আসন, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি। এখানকার স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমি।
১৯৭০ এর দশকে এখানেই আমার পিতা-মাতার বিয়ে হয়েছিল। এখানে বসেই আমি স্থানীয় পত্রিকার জন্য লেখালেখি করি। হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন আমার নিজের বাড়ি। তাই পার্লামেন্টের এ আসনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার জন্য আমি গর্বিত। টিউলিপ বলেন, আমাকে ভোট দিয়ে আপনারা দেখিয়েছেন আপনারা লেবার দলের মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল। আমরা চাই এমন একটি অর্থনীতি যা হবে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের জন্য নয়, সবার জন্য। উল্লেখ্য, হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে রয়েছেন লেবার দলের টিউলিপ সিদ্দিক, কনজার্ভেটিভ দলের সিমন মারকাস, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের মজিদ নওয়াজ, গ্রিন পার্টির রেবেকা জনসন, ইউকিপ থেকে মাগনাস নেইলসেন, ইনডিপেনডেন্ট দলের দি ইউরোভিশনারি ক্যারোল ও দি ইউনির্ভাল দলের রবিন এলিসন। এর মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন ২৩৯৭৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিমন মারকান পেয়েছেন ২২৮৩৯ ভোট। অন্যদিকে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে ১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে ৩২৩৮৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন রুশনারা আলী।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন লেবার দল থেকে রোশনারা আলী, কনজারভেটিভ দলের ম্যাথিউ স্মিথ, গ্রিন পার্টির অ্যালিস্টার পোলসন, ইউকিপ দলের পলা ম্যাককুইন, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের টিনা ল্যাশমোর, টিইউএসসির গ্লিন রবিনস, কমিউনিটিস ইউনাইটেডের এম রওশন আলী, ক্যানাবিস ইজ সেফার দ্যান অ্যালকোল-এর জোনাথন ডিওয়ি, উইগ পার্টির আলাসদাইর হেনডারসন, দ্য ৩০-৫০ কোয়ালিংশনের এলিয়ট বল, রেড ফ্লাগ-এন্টি-করাপশন-এর জেসন পাভলো। এখানে রোশনারা আলীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাথিউ স্মিথ পেয়েছেন ৮০৭০ ভোট। এর আগে ২০১০ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন রুশনারা আলী। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাকে সেনা অভিযানের ব্যাপারে যখন হাউজ অব কমন্স ভোটের আয়োজন করে, তখন তা থেকে বিরত থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বৃটিশ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছেন।
বিজয়ী ঘোষণার পর তিনি বলেন, আমাদের এক হয়ে কাজ কতে হবে। সামনের সময় হবে ভীষণ জটিল। এ সময়ে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি এর আগে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক ছায়ামন্ত্রী ছিলেন। ২০১৩ সালে যখন লেবার পার্টিতে রদবদল হয় তখন তিনি যোগ দেন শ্যাডো এডুকেশন বা শিক্ষাবিষয়ক ছায়া কর্মসূচিতে। রুশনারা আলীর জন্ম সিলেট জেলার বিশ্বনাথে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পাড়ি জমান লন্ডনের ইস্ট এন্ডে। সেখানে তিনি মালবেরি স্কুল ফর গার্লস এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কলেজে পড়াশোনা করেন। বেড়ে ওঠেন টাওয়ার হ্যামলেটসে। তার পরিবারে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন। তিনি সেন্ট জনস কলেজ, অক্সফোর্ডে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর টাওয়ার হ্যামলেটস সামার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন মাইকেল ইয়ং। তার গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন রোশনারা। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের এমপি ছিলেন ওনা কিং। এ সময়ে তার পার্লামেন্টারি সহকারী ছিলেন রুশনারা।
২০০০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক দায়িত্বে। ২০০৭ সালের এপ্রিলে তাকে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে লেবার পার্টির প্রোসপেক্টিভ পার্লামেন্টারি প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়া হয়। ২০১০ সালের ৬ই মে তিনি এ আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন ১১৫৭৪ ভোট পেয়ে। হাউজ অব কমন্সে তিনিই প্রথম নির্বাচিত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি। এ সময় শাবানা মাহমুদ ও ইয়াসমিন কুরেশি নামে দুই নারী প্রথম নারী এমপি নির্বাচিত হন যুক্তরাজ্যে। অন্যদিকে ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড একটন আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন ড. রুপা হক। তিনি পেয়েছেন ২২০০২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কনজার্ভেটিভ পার্টি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাঙ্গি ব্রে। এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট ৯ জন প্রার্থী। রুপা আশা হক ইংরেজি ভাষার লেখক, কলামনিস্ট, লেবার পার্টির রাজনীতিক, কিংসটন ইউনিভার্সিটির সোশিওলজির সিনিয়র লেকচারার, লন্ডন বরো অব ইলিংয়ের সাবেক ডেপুটি মেয়র। তার পিতার নাম মোহাম্মদ মুসজুদ্দিন আবেদুল হক ও মা রোশান আরা হক। তারা ১৯৬০-এর দশকে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন বৃটেনে। উদ্দেশ্য সন্তানদের ভাল ও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়া। রুপা হকের জন্ম হ্যামারস্মিথে অবস্থিত কুইন শার্লটিস হাসপাতালে।