মালয়েশিয়াকে টার্গেট করে সারা বছর মানবপাচার

Malaysia-Towerমূলত মালয়েশিয়াকে টার্গেট করেই সমুদ্র ও আকাশপথে কয়েক বছর ধরে মানবপাচারের শিকার হয়েছেন কক্সবাজার, টেকনাফ, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। এদের অনেকেই পাচারকারীদের অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে স্বপ্নের দেশে পৌঁছতে পারলেও বেশির ভাগেরই স্বপ্ন থেমে গেছে মাঝপথে।
সমুদ্রপথে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের কারো কারো গলা কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে দালালরা, আবার কারো কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে ক্ষোভে নির্যাতনের পর জঙ্গলে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছে। একইভাবে আকাশপথে যারা ট্যুরিস্ট, ভিজিট ও স্টুডেন্ট ভিসার নামে গেছেন, তাদের অনেকেই এখন মালয়েশিয়ায় পুলিশি অভিযানে ধরা পড়ে দেশটির ১১টি ডিটেনশন ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশী বিভিন্ন অভিযোগে বন্দী থাকলেও মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন তাদেও খোঁজখবর নেয়ার সময় পাচ্ছেন না। অসহায় লোকগুলো তাই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় দফায় আবারো দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ থেকে বিমান টিকিটের টাকা জোগাড় করে খালি হাতে (ন্যাড়া মাথায়) দেশে ফিরছেন। এভাবেই সারা বছর মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে এসব মানুষ।
অবৈধপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো এবং দেশটিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খেটে দেশে ফেরা ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এ দিকে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের জঙ্গলে মানবপাচারের শিকার বাংলাদেশীসহ বেশ কিছু দেশের মানুষের গণকবর থেকে কঙ্কাল উদ্ধার এবং জঙ্গল থেকে জীবিত মানুষ উদ্ধারের পর আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ওই সব দেশের সীমান্ত এলাকায় কয়েক দিন ধরে নজরদারি বাড়ানোয় পাচারকারী চক্রের সদস্যরা ট্রলারে ওঠানো অভিবাসীদের ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। এর পরই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ড সীমান্তের বিভিন্ন উপকূল থেকে আটকে পড়া শত শত অভিবাসী উদ্ধার হচ্ছেন।
সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে চারটি নৌযান ভর্তি বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের এক হাজার ৪০০ জন অভিবাসীকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করে। এর মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশী নাগরিক। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক একাধিক সংবাদ সংস্থার খবরে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাজমুল কাউনাইন জানান, উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশের পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। একই সাথে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কনসুলার একসেস চাওয়া হয়েছে।
এর আগে গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার জহুরবারুতে অবস্থান করা মেহেদী হাসান, কামরুলসহ একাধিক যুবক নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিদিন সমুদ্রপথে আর ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্ট ভিসার নামে বিমানে করে আদম মালয়েশিয়ায় আসছে। কিন্তু এখানে এসেই পুলিশি অভিযানে তারা ধরা পড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের জীবন কাটছে মানবেতরভাবে। তিনি প্রশ্ন রেখে জানতে চানÑ এসব কি আমাদের দেশের সরকার জানে না? মানবপাচার বন্ধে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? তারা বলেন, যারা অবৈধভাবে টেকনাফ থেকে ট্রলারে পাড়ি দিয়ে এ দেশে এসেছে তারা বলেছেন, ট্রলারে না খেয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। অনেকে আবার বাগি¦তণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন। পরে তাদের গলা কেটে মিয়ানমার নতুবা থাই সীমান্তে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। মানবপাচারের রুট সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা বলেন, টেকনাফ থেকে একজনকে মালয়েশিয়ায় আনতে দালালরা কোনো নগদ টাকা নেয় না। যাত্রীকে বলে দেয় মাত্র দুই হাজার টাকা সাথে নিতে; চিঁড়া-মুড়ি খাওয়ার জন্য। তবে দালালদের সাথে চুক্তি থাকে মালয়েশিয়া পৌঁছার পর পুরো ছয় হাজার রিংগিট (দেড় লাখ টাকা) দিতে। ইদানীং ট্রলারে মালয়েশিয়া আসার খবর জানাজানি হয়ে গেলে এখন দালালরা বড় বড় জাহাজে করে লোক পাঠাচ্ছে। পাচারের রুট সম্পর্কে তারা বলেন, টেকনাফ থেকে প্রথমে মিয়ানমার সীমান্তে নিয়ে আসে। গ্রিন সিগন্যাল পেলে থাই সীমান্তে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের নেয়া হয় শংখল প্রদেশের গহিন জঙ্গলে। এরপর মালয়েশিয়া সীমান্তের পাচারকারীরা গ্রিন সিগন্যাল দিলে তখন তাদের মালয়েশিয়া উপকূল পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে পেনাং, পোর্টকেলাং দিয়ে নিজস্ব গোপন আস্তানায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর দালালরা প্রত্যেকের ঢাকায় থাকা পরিবারের কাছে চুক্তির টাকা টেলিফোনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে দিতে বলে। আর এ টাকা ঢাকায় পরিশোধ করলেই গোপন ওই আস্তানা থেকে তাদের মুক্তি মেলে। তারা বলেন, ট্রলারে আনার পাশাপাশি আকাশপথেও প্রতিদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন ফাইটে মালয়েশিয়ায় লোক আসছে। স্টুডেন্ট, ট্যুরিস্ট ভিসার নামে প্রতিদিন লোক আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে দালালরা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিচ্ছে; কারণ দুই বিমানবন্দরেই লাখ টাকা খরচ করতে হয়।
গত সপ্তাহে মালয়েশিয়া থেকে শ্রমিক মাজহারুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার ভাই কালাম ঢাকার এইচ টি গ্লোব ট্রাভেল থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় আসে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে একটি হোটেলে পার্টটাইম কাজ শুরু করে। কাজ করা অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টার দিকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। খবর পেয়ে আমরা কুয়ালালামপুরের ইমিগ্রেশনের ডিটেনশন ক্যাম্পে খোঁজ নিতে যাই। মামলা হওয়ায় পুলিশ তার সাথে দেখা করতে দেয়নি। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের (মড়ড়হ ঁহরাবৎংরঃু) নামে সে এসেছিল। তার পাসপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে থাকায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে মালয়েশিয়া হাইকমিশনের কর্মকর্তা আনিসের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের বলেন, আমার দায়িত্ব শুধু ওই কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া। আমি জানিয়েও দিয়েছি। এখন অ্যাকশন নেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এর বেশি আমার কিছু করার নেই। পরে ফারুক নামের এক দালালের সহযোগিতায় এক হাজার ২০০ রিংগিট খরচ করে টিকিট কেটে ভাইকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। তিনি অভিযোগ করেন, শুধু কালাম নয়, তার মতো হাজার হাজার বেকার মানুষ এখন জমিজমা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ার আসছেন। মালয়েশিয়ায় কাজের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি হওয়ায় অনেকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। অথচ এই চক্রের সাথে যারা জড়িত তাদের কেউ ধরা পড়েছে এমন নজির নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফকিরেরপুল, বিজয়নগর, মতিঝিল, নয়াপল্টন, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ট্রাভেল ও ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের আড়ালে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মানবপাচারকারী চক্র। এরাই এখন ঢাকার মালয়েশিয়া হাইকমিশন থেকে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ভিসা নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে মালয়েশিয়ায়। এসব অনিয়ম দেখার দায়িত্ব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার। কিন্তু তাদের তৎপরতা কয়েক দিন থাকার পর রহস্যজনক কারণে থেমে যায়; যে কারণে আবারো শুরু হয় একই কায়দায় মানবপাচার বাণিজ্য। সূত্রে জানা গেছে, নয়াপল্টনের সিটি হার্ট বিল্ডিংয়ে ট্যুরিস্ট ও ভিজিট ভিসার নামে চলছে রমরমা বাণিজ্য। অনেকে আবার ট্রাভেল এজেন্সির আড়ালে মালয়েশিয়ার ভিসা প্রসেসিং, টিকিট, বিমানবন্দর কন্ট্রাক্টসহ মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কাজ অবাধে করছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যরা বিষয়টি অবগত হলেও তারাও বিষয়টি না দেখার ভান করে রয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
গতকাল জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার একাধিক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে  বলেন, মালয়েশিয়ায় বেসরকারিভাবে লোক পাঠানো বন্ধের পর থেকেই অবৈধভাবে লোক যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, সরকারিভাবে (জি টু জি) দেশটিতে প্রায় দুই বছরে ৮-৯ হাজার লোক গেছে। এখন সেটিও প্রায় বন্ধ। এ সুযোগে দালালরা প্রলোভন দেখিয়ে কখনো সাগরপথে কখনো আকাশপথে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছে। এর ফলে মানবপাচারের পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তারা বলছেন, বেসরকারিভাবে লোক পাঠানোর সুযোগ দিলে অবৈধভাবে লোক যাওয়ার হার অনেক কমে যাবে। তারা বলেন, নেপাল থেকে ৫০ হাজার টাকায় লোক যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। নেপাল পারলে আমরা কেন পারব না? সরকার শুধু আমাদের মনিটরিং করবে। এর পরও যদি কেউ বেশি টাকা আদায় করে তাহলে ওই এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নেবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.