সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়া নিখোঁজদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে

indexthaiooথাইল্যান্ডের জঙ্গলে মালয়েশিয়াগামীদের গণকবরের সন্ধান ও লাশ উত্তোলনের খবরে কক্সবাজারে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে অবৈধভাবে পাড়ি জমিয়ে নিখোঁজ হওয়া মানুষের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এর আগে কত মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে গহিন জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবরে নিখোঁজ মালয়েশিয়াগামীর স্বজনদের মাঝে কান্নার রোল পড়েছে। চলছে শোক। বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কান্নার রোল উঠেছে স্বজনদের মধ্যে।
জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে উপকূলে ৫ হাজার ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়া ট্রলারডুবি ও দালাল চক্রের হাতে খুন হন অনেকে। থাইল্যান্ডের গহিন বনে একের পর এক গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় কক্সবাজার উপকূলের নিখোঁজ এই পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবারে চলছে শোক।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ বলেন, ‘এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই মানুষ মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে প্রায় ৩০০ মানুষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজদের অধিকাংশই থাইল্যান্ডের গহিন বনে সন্ধান পাওয়া গণকবরে ঠাঁই হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। এ কারণে এখানে ঘরে ঘরে চলছে শোক।’
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের দুই হাজারেরও বেশি মানুষ মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত অর্ধসহস্রাধিক মানুষের খোঁজ মিলছে না। থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর এখন আমাদের এলাকায় নিখোঁজদের পরিবারে কান্নার রোল পড়েছে।’
সীমান্তবর্তী উপকূলীয় টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারঘোনার করাচিপাড়া গ্রামের সুলতান আহমদ মিস্ত্রির তিন ছেলে দুই বছর আগে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঘর ছাড়েন। ঘর ছাড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন সন্তান মোহাম্মদ ইসমাইল, মোহাম্মদ তৈয়ব ও মোহাম্মদ সিদ্দিকের কোনো খোঁজ পাননি বলে জানান তাদের বাবা সুলতান আহমদ মিস্ত্রি। সুলতান আহমদ মিস্ত্রির প্রতিবেশী ও স্বজন মরহুম সৈয়দ আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ আমিন, মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবদুল শুক্কুর, রশিদ আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিমও সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রার দুই বছর হতে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানান তাদের স্বজনেরা।
কক্সবাজার জেলা শহরের সমিতিপাড়ায় বসবাস ফারেছা বেগমের। দুই বছর আগে তার স্বামী ট্রলারে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রা করেন। ফারেছা জানান, যাত্রার এক সপ্তাহ পর স্বামী বদিউল আলম মুঠোফোনে তাকে জানিয়েছিলেন, তিনি থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপে আটকা পড়েছেন। এরপর পার হয়েছে দুই বছর। এর মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি স্বামীর সাথে। এখন সন্তানদের মুখে দুই মুঠো ভাত জোগাতে পরিছন্নতা কর্মীর কাজ নিয়েছেন কক্সবাজার পৌরসভায়।
মানব পাচাররোধে মাঠপর্যায়ে কর্মরত উখিয়ার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হেলপের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাসেম জানান, মানবপাচারসংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে তাদের সংস্থার কাছে পাঁচ শতাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমা পড়েছে। ওই সব অভিযোগ সরেজমিন তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের উপকূল দিয়ে গত পাঁচ বছরে অর্ধলাধিক লোক সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছেন। এর মধ্যে সাড়ে তিন হাজার লোকের কোনো খোঁজ পাননি তাদের স্বজনেরা।
তিনি জানান, সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মালয়েশিয়াগামী পরিবারগুলোর মধ্যে অজানা শঙ্কা বিরাজ করছে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর পুলিশের পে দায়ের করা এক প্রতিবেদনে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে জড়িত ২৩০ দালালকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর সাথে জড়িত ২৬ হুন্ডি ব্যবসায়ীও চিহ্নিত হয়। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রতারিত মানুষের দায়ের করা মামলায় এদের বেশি আসামি হলেও কার্যত কারো বিরুদ্ধে হয়নি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বরং মামলা করে হুমকি-ধমকিতে এবং হয়রানিতে শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
পুলিশের সূত্র মতে, ২০১২ মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর কক্সবাজারে এ-সংক্রান্ত মোট মামলার সংখ্যা ৩০৬টি। এর মধ্যে আসামি এক হাজার ৫৩১ জন। কিন্তু এর মধ্যে আদালতে পৌঁছেছে ১৬৬টি মামলা। আর ১৪০টি মামলা রয়েছে পুলিশের তদন্তে।
আদালতের তথ্য মতে, ২০১২ সালের ৩টি মামলার মধ্যে ১টি নিষ্পত্তি হয়েছে বিচারাধীন রয়েছে ২টি, ২০১৩ সালের ৫২টি মামলার মধ্যে ৮টি নিষ্পত্তি হয়েছে বিচারাধীন রয়েছে ৪২টি, ২০১৪ সালের ৭৭টি মামলার মধ্যে ৩টি নিষ্পত্তি হয়েছে বিচারাধীন রয়েছে ২টি, ২০১৫ সালের এ পর্যন্ত ৩৪ টি মামলার মধ্যে ২ ট নিষ্পত্তি হয়েছে বিচারাধীন রয়েছে ৩২টি। আদালতের ১৬৬টি মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত ১৪টি নিষ্পত্তি হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘মানবপাচার বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা জিরো টলারেন্স। এটি শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে সব কিছু করছে পুলিশ। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, মানবপাচার সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে রা পেতে সমাজের সব স্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.