ভারতের বৃহত্তম এয়ারলাইন জেট এয়ারওয়েজ ইন্ডিয়া লিমিটেডের সিংহভাগ শেয়ার মাত্র ১ রুপিতে (১ সেন্টের কম) বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। মূলত প্রতিষ্ঠানটির রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের মাধ্যমে বেইলআউট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে মূলত কোম্পানিটি নতুন ইকুইটি জোগাড়ে সময় হাতে পাবে এবং পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সমর্থ হবে। গতকাল শেয়ার বিক্রির এ জটিল প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। দেশটিতে নির্বাচনের কিছুদিন আগে খুবই সংবেদনশীল সময়ে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে।
জেট এয়ারওয়েজ
এক দশক ধরে ভারতে যে তিনটি উড়োজাহাজ সংস্থা শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, তার মধ্যে জেট এয়ারওয়েজ একটি। টিকিট বিক্রির এজেন্ট থেকে উদ্যোক্তা বনে যাওয়া নরেশ গয়েলের হাত ধরে এ উড়োজাহাজ সংস্থাটির যাত্রা। মূলত নব্বইয়ের দশকে জেট এয়ারওয়েজের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে ভারতে এভিয়েশন খাতে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান হয়। বর্তমানে আবুধাবির ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কাছে জেট এয়ারওয়েজের ২৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল বাজারগুলোর অন্যতম ভারতের আকাশ চলাচল খাতে জেট এয়ারওয়েজের দখল ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। লন্ডন ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে সংস্থাটি।
জেট কেন সংকটে?
একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের বাজারে বেশকিছু সাশ্রয়ী উড়োজাহাজ সংস্থার আবির্ভাব ঘটে। এ সময় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে জেট এয়ারওয়েজ টিকিটের মূল্য কমাতে শুরু করে, অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, খরচের চেয়েও কমে তাদের টিকিট বিক্রি করতে হয়েছে। এর ওপর বিমানের জ্বালানির ওপর ৩০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কর তাদের ব্যয়ের বোঝা আরো বাড়িয়ে দেয়। আর খরচ নিয়ে অতি সচেতন ভারতীয় ভ্রমণকারীরা উড়োজাহাজে সরবরাহ করা খাবার ও বিনোদন বাবদ অর্থ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে সাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় ভিন্নভাবে কার্যক্রম পরিচালনা সত্ত্বেও গ্রাহকদের এ সুযোগ-সুবিধা প্রায় বিনা মূল্যে দেয়া শুরু করে সংস্থাটি। আর এসব করেই গত ১১ বছরে নিজেদের ঘাড়ে ৭ হাজার ২৯৯ কোটি রুপি বা ১০০ কোটি ডলারের ঋণের বোঝা চেপেছে। ব্লুমবার্গের প্রকাশ করা এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ পর্যন্ত উড়োজাহাজ সংস্থাটির হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৫৫ কোটি রুপি। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধযোগ্য ঋণ প্রদানেও সক্ষম হয়নি এবং কর্মী ও ইজারাদাতাদের পাওনা পরিশোধেও বিলম্ব করছে তারা।
প্রস্তাবিত চুক্তিটি কী?
জেট এয়ারওয়েজকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে একদল ঋণদাতা মাত্র ১ রুপিতে জেট এয়ারওয়েজের ৫০ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির ১১ কোটি ৪০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক ইন্ডিয়ার পরিকল্পিত কাঠামোর অংশ হিসেবেই এ উদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ কাঠামো স্থায়ী হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মূলত এর মাধ্যমে এয়ারলাইনটি বিনিয়োগকারীদের থেকে ইকুইটি সংগ্রহ করতে পারবে। নিজের পায়ে পুনরায় দাঁড়াতে জেট এয়ারওয়েজের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি রুপি প্রয়োজন। ফলে কোম্পানিটির প্রয়োজন ও সামর্থ্যের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, তা পূরণ করতে নতুন ইকুইটির জোগান দেয়া, ঋণ পুনর্গঠন এবং উড়োজাহাজ বিক্রি ও পুনরায় এগুলো ইজারা দেয়ার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পুনরুদ্ধার কেন প্রয়োজন?
এ উড়োজাহাজ সংস্থাটির পতন হলে ২৩ হাজার কর্মী কাজ হারাবেন, যা কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য দুটি বিপদ ডেকে আনবে। এক তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পতন তার ব্যবসাবান্ধব ভাবমূর্তির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হলে চরম সমালোচনার সৃষ্টি হবে, যা নির্বাচনের আগে তার জন্য মোটেও সুখকর নয়।
মুম্বাইভিত্তিক উড়োজাহাজ সংস্থাটি বাজার থেকে হারিয়ে গেলে উড়োজাহাজ টিকিটের দামও বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের মোট ৩৭টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে জেট এয়ারওয়েজ।
ইতিহাদের শেয়ারের কী হবে?
অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আবুধাবিভিত্তিক উড়োজাহাজ সংস্থাটি রুটের সংখ্যা কমিয়ে আনছে এবং কয়েক হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। মূলত ব্যয়বহুল সম্প্রসারণের পর গত দুই বছর ৩৫০ কোটি ডলার লোকসান হওয়ার কারণেই এ পদক্ষেপ নিচ্ছে সংস্থাটি। ফলে পুনরুদ্ধার হওয়ার পর জেট এয়ারওয়েজ ইতিহাদের রুটগুলোয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে এবং পশ্চিমাগামী ভারতীয়দের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে।
ভারতের অন্য উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর কী অবস্থা?
ভারতে উড়োজাহাজ সংস্থার ব্যবসা পরিচালনা করা খুবই দুরূহ একটি ব্যাপার। সাংঘাতিক প্রতিযোগিতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই টিকতে পারছে না। টাইকুন বিজয় মাল্যের প্রতিষ্ঠা করা কিংফিশারের কার্যক্রম ২০১২ সালে গুটিয়ে নেয়া হয়। ব্যাংক, কর্মী ও ইজারাদাতাদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেড বেইলআউটের অর্থে টিকে রয়েছে। বিদেশী উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোও এখানে বিনিয়োগ করে সুবিধা পাচ্ছে না। ইতিহাদ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস ও এয়ারএশিয়া স্থানীয় ভেঞ্চার গঠন করলেও সবাই লোকসানে রয়েছে।