এভিয়েশন নিউজ: ভারতে পাচারের জন্যই বাংলাদেশে স্বর্ণ আসে। দেশের অভ্যন্তরের যে চাহিদা তা মেটাতে স্বর্ণ পাচারের প্রয়োজন হয় না। সূত্র বলছে, প্রতিবেশি দেশে চাহিদা থাকায় এক ধরনের অসাধু চক্র দেশে অবৈধ পথে স্বর্ণ এনে তা ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত ভারতীয় পাচারকারীরাও। কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতে, দেশের বিমানবন্দরে যে পরিমাণ সোনা আটক করা হচ্ছে তার চাহিদা বাংলাদেশে নেই। একই মত বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) ব্যবসায়ীদেরও।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি দিলীপ রায় বলেন, রিসাইকেলিং করে পাওয়া সোনা আর বিদেশে থেকে যাত্রীদের অবৈধভাবে আনা সোনাই দেশে জুয়েলারি ব্যবসার মূল উৎস। এর বাইরে ব্যবসায়ীরা কোনো স্বর্ণ আমদানি করেন না। সাম্প্রতিক আটককৃত স্বর্ণ ভারতের জন্য। এতো স্বর্ণের চাহিদা বাংলাদেশে নেই- জোর দিয়ে বলেন এই স্বর্ণ ব্যবসায়ী নেতা। এ বক্তব্যে একমত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনও। সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে গোলাম হোসেন বলেন, ভারতে স্বর্ণ আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ জারি করায় একটি গ্রুপ ভারতে স্বর্ণ পাচারের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে।
আগে ভারতে যেকোনো সংস্থা স্বর্ণ আমদানি করতে পারতো। তবে ২০১৩ সালে ঢালাওভাবে স্বর্ণ আমদানি নিষিদ্ধ করে কয়েকটি এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। গত বছরের আগস্টে স্বর্ণ আমদানির ওপর ছয় শতাংশ শুল্ক তিন দফায় বাড়িয়ে তা ১০ শতাংশ ধার্য করে দেশটির সরকার (সূত্র: ব্লুমবার্গ)। এ হিসাবে, বাংলাদেশে ১০ গ্রাম স্বর্ণ আমদানির জন্য ১৫০ টাকা আর সমপরিমাণ স্বর্ণের জন্য ভারতে ৪ হাজার ২০০ টাকা শুল্ক গুনতে হয়।
বিমানবন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য নিরাপদ মনে করেন। কারণ, বাংলাদেশের বিমানবন্দরে স্বর্ণের চালান আটক করলে আসামির বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কাস্টমস বিভাগ ব্যবস্থা নেয়। তবে ভারতে অবৈধভাবে স্বর্ণ প্রবেশ করালে ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিমানবন্দর কাস্টমস বিভাগের পাশাপাশি সিবিআই (সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন), দুর্নীতি দমন কমিশন ও আয়কর বিভাগ একযোগে ব্যবস্থা নেয়। শুধু স্বর্ণের চালান নয়, একপর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীর সব সম্পদ জব্দ করে নেওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে ভারতে।
বিমানবন্দর কাস্টমস, গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম বলেন, ভারতের জন্যেই যে স্বর্ণ আসে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে স্বর্ণ আটকের বিষয়টি দেখে বোঝা যায় যে, ভারতে স্বর্ণ পাচার হয়। এর আগে মার্চ মাসে কলকাতা থেকে ৪১ কেজি স্বর্ণসহ তৃণমূল কংগ্রেসের দুই সদস্যকে আটক করে বিএসএফ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচারের কথা স্বীকার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য বাংলাদেশের হিলি, বেনাপোল, ও আখাউড়া ও সোনা মসজিদ স্থলবন্দরকে নিরাপদ মনে করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আর তাদের এজেন্টরা জয়ন্তীপুর, হরিদাসপুর, সুটিয়া, বাঁশঘাট সীমান্তকে নিরাপদ মনে করে বেশিরভাগ স্বর্ণ এসব সীমান্ত থেকে গ্রহণ করেন। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন বিভিন্ন দেশের উড়োজাহাজের কর্মকর্তারা।
এয়ারপোর্টে কর্মরত আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন জানান, স্বর্ণের বড় চালানগুলো বিমানের প্যানেলবক্স, লোডার, পোর্টার, টয়লেটের কমোডের পেছনের চেম্বার, লাগেজ চেম্বার ও কার্গো হলের ভেতর থেকে পাওয়া যায়। এই জায়গাগুলোতে উড়োজাহাজের কর্মকর্তারা ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ১০৫ কেজি স্বর্ণ আটকের পর এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন, বিমানের ফ্লাইটে যেভাবে স্বর্ণগুলো রাখা হয়েছে, এতেই স্পষ্ট যে, এটি কোনো ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা করানো। কারণ, চেম্বার খুলে যাত্রীর পক্ষে স্বর্ণ রাখা সম্ভব নয়।
এপিবিএনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধের জন্য বিভিন্ন উড়োজাহাজের ৩৪ জন বিমানবালা, ২ জন কাস্টমস কর্মকর্তা, ৬ জন এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা ও বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার ৭১ জনকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে বিমানবন্দর কাস্টমসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বিমানবন্দর থেকে ১২ কেজি, ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২ সালে ২৪ কেজি, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮০০ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে আটককৃত ১২৪ কেজি, ১০৭ কেজি এবং ১০৫ কেজির স্বর্ণের তিনটি বড় চালান ছিলো। এই চালানগুলো ভারতে পাচার করার জন্যই আনা হয় বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, এমন কথা বলেছে বিমানবন্দরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র।