অবশেষে স্থগিত হল বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারের (বিএফসিসি) সব ধরনের নিয়োগ। মঙ্গলবার বিমান ম্যানেজমেন্টের এক আদেশে এই সিদ্ধান্ত জানা গেছে। ইতোমধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিতের বিষয়টি বিএফসিসি নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য সম্প্রতি এভিয়েশন নিউজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাড়াই বিএফসিসিতে জুনিয়র অপারেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট, ভেহিকেল অপারেটর, বেকার হেলপার, প্যান্ট্রিম্যান ও কিচেন হেলপার পদে লোক নিয়োগ করা হবে মর্মে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জানাগেছে এই রিপোর্টের পরই মন্ত্রনালয় ও বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট এই সিদ্ধান্ত দেন। বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকার বিএফসিসিতে সব ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এভিয়েশন রিপোর্টে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল লোক নিয়োগের বিজ্ঞাপন বিএফসিসির গেটে টাঙিয়েই শুধুমাত্র চাকরীপ্রার্থীদের জানানো হয়। আর কোথাও এ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। দেশের সাড়ে তিন কোটি বেকারের মধ্যে যাঁরা কেবল ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে বিএফসিসির অফিসে যাবেন তাঁদের পক্ষেই জানা সম্ভব হবে শতাধিক পদে লোক নিয়োগের এ তথ্য। অন্য কারো পক্ষে জানাও সম্ভব নয়, আবেদন করাও সম্ভব নয়।
বিমানের লোক নিয়োগের এ প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ বিমানের জনবলের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। সরকারের তরফ থেকে বারবার বিমানকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত করার জন্য। শুধু সরকার নয়, বিশ্বব্যাংকও বিভিন্ন ঋণ দেওয়ার আগে সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত হয়ে গেলে উল্টাপাল্টা লোক নিয়োগ করা যাবে না, আর এভাবে লোক নিয়োগ না করা গেলে টাকা কামানোর রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই কোনো সাংগঠনিক কাঠোমো নয়- বিমানের নীতি যেন এ রকমই।
শুধু সাংগঠনিক কাঠামোতেই অনিয়ম হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। জনবল তিন হাজার ৪০০তে নামিয়ে আনাসহ চারটি শর্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে কম্পানি করা হয় ২০০৭ সালে। কম্পানি করার আট বছর পর এখন বিমানের জনবল পাঁচ হাজার ৩৮ জন। বিমানের ‘লাভের গুড় অপ্রয়োজনীয় জনবলে খেয়ে ফেলা’র বিষয়টি বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদন, অডিট রিপোর্ট, সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তুলে ধরা হলেও এ বিষয়ে কারো নজর নেই।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বিমানের সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়নের কাজ চলছে। আশা করি, শিগগিরই তা চূড়ান্ত হবে।’ মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরীর বক্তব্যও একই ধরনের। কিন্তু বিমানের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০০৭ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আদলে কর্মচারীদের বাড়ি পাঠানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৩০৫ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। ঋণের ১২ দফা শর্তের মধ্যে ছিল বিমানের সাংগঠনিক কাঠামো চূড়ান্ত করা, যা আজও হয়নি। মাঝখানে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির জন্য চুক্তি করেছিল বিমান। কিন্তু সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি।
বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজার বলেন, বিএফসিসিতে যে নিয়োগ হবে তার সবই অস্থায়ী পদ। এসব পদে মাত্র ৯০ দিনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে। অস্থায়ী পদে পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়েও লোক নিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু জেনারেল ম্যানেজারের যুক্তি খণ্ডন করে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ৯০ দিনের জন্য বলা হলেও তাঁদের চাকরি এরপর শেষ হয়ে যায় না। ৯০ দিন করে বাড়াতে বাড়াতে এক সময় তাঁরা বিমানে স্থায়ী হয়ে যান। এভাবেই বিমানে লোক নিয়োগ হচ্ছে এবং সরকারের দেওয়া টার্গেট অতিক্রম করে গেছে। বিমানের একজন পাইলট (প্রশাসনিক দায়িত্বপালনকারী) বলেন, কম্পানি করার সময় বিমানে তিন হাজার ৪০০ জনবল রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ট্রাফিক হেলপার পদ নেই। এই পদটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিয়ে থাকে। এটা থেকে বছরে বিমানের লাভ হয় ৩০০ কোটি টাকা। এই অবস্থায় ট্রাফিক হেলপার পদে লোক নিয়োগ করতেই হবে। এসব পদে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক নিয়োগ করা হয় না। বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক নিয়োগ অনেক ঝক্কিঝামেলা। এসব ঝামেলা এড়াতেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না।
গত ৮ মার্চ বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে বলেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিমানে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মচারীর অনেকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। মন্ত্রিসভার অনুমোদিত জনবলের চেয়ে অতিরিক্ত জনবল থাকায় প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আপত্তি জানাচ্ছে সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
অতিরিক্ত জনবলের জন্য বিমানে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে জানতে চাইলে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সালে জনবল কমানোর নির্দেশ দেয় মন্ত্রিসভা। এর পরের বছরই অতিরিক্ত জনবল থাকায় বিমানের ক্ষতি হয়েছে ৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। অতিরিক্ত জনবল থাকায় ক্ষতির হার পরের বছরগুলোতে আরো বেড়েছে। সব মিলে গত আট বছরে অতিরিক্ত জনবলের পেছনেই ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকার বেশি। ২০০৭ সালের নির্দেশনার পর জনবল কিছুটা কমানো হয়েছিল। কিন্তু পরের বছর থেকে তা আবার বাড়ানো হচ্ছে। ওই বছর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও কর্মচারী নিয়োগ করে তাদের বেতন-ভাতা দেওয়ায় বিমানের ক্ষতি হয়েছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া বিমানের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনায়ও অদক্ষতা রয়েছে। সংস্থাটির পদে পদে অনিয়মের কথা জানান বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, যে যেভাবে পারছে বিমানকে ব্যবহার করছে। একটা পিয়ন তাঁর জায়গা থেকে, আর একজন পাইলট তাঁর অবস্থান থেকে অনিয়ম করছেন। বিভিন্ন চুক্তির শর্ত পূরণ করতে না পারায়ও সংস্থাটি প্রতিদিন ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। কাজ ছাড়াই পরামর্শক ফি দেওয়া হয়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত কর্মচারীদের চুক্তির বেশি টাকা দেওয়ার অভিযোগও অনেক দিনের।
বিমানে ফ্লাইট স্টুয়ার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুমাইয়া আক্তার ঈশিকা। হঠাৎ করেই তিনি আবেদন করেন তাঁকে ফ্লাইট থেকে সরিয়ে বিএফসিসির ইক্যুইপমেন্ট ম্যাটারিয়াল প্ল্যানিং অ্যান্ড প্রভিশনিক অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে পদবি পরিবর্তনের জন্য। এ পদের জন্য তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞানে স্নাতক বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগতযোগ্যতা মানবিকে স্নাতক হওয়ার পরও নতুন পদে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি নজরে আনা হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রহমাতুল মুনিম এক তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানের লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, বিমানে এমনভাবে বিধিবিধান করে নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রকৃত মেধাবীরা কম সুযোগ পাচ্ছেন। পাইলট হিসেবে বিমানে যোগ দিতে হলে ১০০ নম্বরের লিখিত এবং ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এরপর মনস্তাত্ত্বিক ও মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই চলে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর অত্যন্ত বেশি হওয়ায় প্রার্থী বাছাইয়ে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ রয়েছে। এরই ফসল একই পরিবারের ছয়জন সদস্য বর্তমানে বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। একই পরিবারের চারজন পাইলট বিমানে কর্মরত- এমন উদাহরণ একাধিক। অর্থাৎ কর্মরত পাইলটদের ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনরাই পাইলট হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লিখিত পরীক্ষার সমপরিমাণ মৌখিক পরীক্ষার নম্বর থাকলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সুযোগ থাকে।
বিমানের একজন পরিচালক জানিয়েছেন, যখন যে বিভাগে লোক দরকার সেই বিভাগের পরিচালক বোর্ডে নোটিশ দিয়ে লোক নিয়োগ করছেন। বিমানে ট্রেড ইউনিয়ন আরো বেড়েছে, যদিও আপাতত এসব ইউনিয়নের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। কারণ বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন আহমদ কঠোরভাবে এসব ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিন্তু যেকোনো সময় এসব ইউনিয়ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। ইউনিয়নের নেতারা কাজ না করে দলেবলে বিমানের বিভিন্ন স্থাপনায় ঘুরে বেড়ান। তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পছন্দমতো কর্মচারীদের লোভনীয় জায়গায় পোস্টিং দিতে বাধ্য করছেন। অর্থাৎ যেসব জায়গায় অবৈধ টাকা, স্বর্ণ বা অন্য সব চোরাচালানের সুযোগ রয়েছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। সংস্থাটিতে বর্তমানে ১০টি ট্রেড ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে।