সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এমনকি সরকারের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায়ই স্থান পায়নি সুমদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি। ফলে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের জীবনঝুঁকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।
কয়েক বছর ধরে সমুদ্রপথে পাড়ি দেওয়া এসব মানুষের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। ২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনী মাছ ধরার নৌকা থেকে ১৩৮ জনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করলে বিষয়টি প্রকটভাবে নজরে আসে। সর্বশেষ থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের জঙ্গল থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধারের ঘটনায় মানব পাচারের বীভৎস রূপ সামনে চলে আসে।
জনশক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তুত সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু কোনোভাবে সে দেশে পৌঁছাতে পারলেই কাজ পাওয়া যায়—এমন বিশ্বাসে লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। বৈধভাবে কর্মী যাওয়ার সুযোগ থাকলে পাচার অনেকটা বন্ধ হয়ে যেত। এ ক্ষেত্রেও সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি সমালোচিত হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ২০১৪ সালের শুরু থেকেই সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে বার্তা পাঠিয়েছে। গত বছরের মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একাধিক চিঠি পাঠানো হয় ঢাকায়। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন সময় বেশ কয়েক শ বাংলাদেশি ওই দেশের শংখলা প্রদেশ ও সাদাওতে আটক হয়েছেন। সীমান্তে কঠোর নজরদারি, মানব পাচার ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সমুদ্রপথে মানব পাচার বন্ধ করা জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়েও এই ‘জরুরি বার্তা’ পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু মানব পাচারের বাড়বাড়ন্ত অবস্থা প্রমাণ করছে, ওই সব ‘জরুরি বার্তা’ খুব কানে তোলেনি প্রশাসন।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সমুদ্রপথে মানব পাচারের প্রসঙ্গই নেই। জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা ও বিধিমালা, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালাও গত তিন বছরে হয়নি
অবশ্য কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ বিচ্ছিন্নভাবে পাচারের শিকার লোকজনকে আটক করেছে। কিন্তু পাচারকারীদের ধরা হয়নি। এখন মানব পাচার নিয়ে যখন সারা বিশ্বে হইচই শুরু হয়েছে, তখন অন্তত পাঁচজন সন্দেহভাজন পাচারকারী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। যদিও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার’ নিয়েও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়ে আসছে।
শুধু দূতাবাসই নয়, অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলোও মানব পাচার নিয়ে কয়েক বছর ধরে সরকারকে সতর্ক করে আসছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাও (আইওএম) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সমুদ্রপথে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। এসব সংস্থা বৈধভাবে লোক পাঠানো বৃদ্ধি, সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা, পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক ভাঙাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল।
মানব পাচার বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিবছর ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত বছরও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার বন্ধে বাংলাদেশের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। সমুদ্রপথে মানব পাচারের কারণে এবারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান নিচে নেমে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরকার কী করছে: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০০৮ সালে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১১ সালে। দ্বিতীয় আরেকটি কর্মপরিকল্পনা ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৪ সালে শেষ হয়। পাচার বন্ধের সব কার্যক্রম এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু দুটি পরিকল্পনার একটিতেও সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি ছিল না। এমনকি ২০১৫-১৭ সালের খসড়া কর্মপরিকল্পনায়ও এ বিষয়টি স্থান পায়নি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এটি সত্যি সাগরপথে মানব পাচারের দিকে আগের দুই পরিকল্পনায় নজর ছিল না। তবে এবার আমরা এটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব। ইতিমধ্যে সমুদ্রপথে পাচার বন্ধে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি।’
আবার ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন পাস হয়। আইনের অধীনে জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা ও বিধিমালা, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ তহবিল ও বিধিমালা করার কথা থাকলেও গত তিন বছরে কিছুই হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ‘বিধিমালাগুলোর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
মানব পাচার বন্ধে ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন নামে আরেকটি আইন করা হলেও সেটি পাচার বন্ধে কাজে আসছে না। জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা বৈধভাবে লোক পাঠাই। পাচার বন্ধ করার কাজটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।’ তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘এখন সরকার কঠোর হবে। পাচারে জড়িতদের নির্মূল করা হবে।’
২০১৪ সালের কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ শেষে মানব পাচার পরিস্থিতির ওপর একটি জরিপ হওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা এমনকি সব ইউনিয়নে পাচার প্রতিরোধে কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ জায়গায় তা হয়নি। অনেক জায়গায় কমিটি থাকলেও কাজ করছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক সি আর আবরার বলেন, ‘সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি যদি শুরুতেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হতো, তাহলে আজকের এই সংকট হতো না। সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ, এখন যেন আমরা এমন ব্যবস্থা নিই, যাতে করে এই পাচার বন্ধ হয়।’
আরও খবর