দুর্গতদের সাহায্যে সীমান্ত ও বন্দর খোলা রাখুন :জাতিসংঘ
ভেসে থাকা মানুষদের নামার সুযোগ দিন :যুক্তরাষ্ট্র
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের আচেহ’র পূর্ব উপকূলে ডুবতে বসা একটি নৌকা থেকে শিশু ও নারীসহ প্রায় আটশ’ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় নৌকাটি ডুবতে বসলে জেলেরা তাদের উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতদের আচেহ প্রদেশের লাংসা শহরে রাখা হয়েছে। এদিকে, প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান এবং বাংলাদেশি অভিবাসী বহনকারী নৌকাগুলোকে ভিড়তে না দিয়ে সাগরে ঠেলে দেয়ার নীতির সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ। আর মালয়েশিয়ার উদ্দেশে এই মানবপাচার বন্ধে ও ভেসে থাকা মানুষের জীবন বাঁচাতে আঞ্চলিক সমাধানের উপর জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গতকাল ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় সময় ভোরে আচেহ’র উপকূলে সাড়ে সাতশ’র বেশি অভিবাসী নিয়ে একটি নৌকা ডুবতে বসেছিলো। এ সময় ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা তাদের উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ৭৯৪ জনকে মধ্য সাগর থেকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে এসেছে জেলেরা। এদের মধ্যে ৬১ শিশু রয়েছে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে এদের মধ্যে ২১০ জন মিয়ানমার থেকে এসেছে। ৩৯৫ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। লাংসা শহরের এক কর্মকর্তা খায়রুল নোভা বলেন, সাময়িকভাবে তাদেরকে বন্দরের একটি গুদামে নিয়ে রাখা হয়েছে।
শহরের পুলিশ প্রধানের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, নৌকাটির গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। কিন্তু সে দেশের নৌবাহিনী নৌকাকে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমার দিকে ঠেলে দেয়। আচেহ উপকূলে পৌঁছানোর পর নৌকাটি ডুবতে শুরু করলে স্থানীয় জেলেরা এগিয়ে যান এবং যাত্রীদের উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসেন। সেখানে প্রায় সাড়ে সাতশ’ যাত্রী ছিলো।
মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর টহল নৌযান গত বুধবার পেনাং ও লাংকাওয়ী উপকূল থেকে দুটি নৌকাকে গভীর সাগরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। দ্বিতীয় নৌকাটিও ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় থাকতে পারে বলে স্থানীয় কর্মকর্তাদের ধারণা। উপকূলের কাছাকাছি অন্য আরেকটি নৌকায় ছিল ৪৭ জন অভিবাসী। ক্ষুধার্ত এসব মানুষ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারের জন্য মিনতি জানায়। পরে স্থানীয় জেলেরা তাঁদের উদ্ধার করে। এর আগে গত সপ্তাহে প্রায় এক হাজার অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়া।
অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেয়ার নীতির
সমালোচনায় জাতিসংঘ
সমুদ্রে ভেসে থাকা অভিবাসীদের তীরে ভিড়তে না দিয়ে সমুদ্রে ফেরত পাঠানোর নীতির সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ। সংস্থার মহাসচিব বান কি মুন দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে নিজ নিজ দেশের সীমান্ত ও বন্দর খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিপদগ্রস্ত নৌকাগুলো উদ্ধার করতে এসব দেশের একটি দায় রয়েছে। বৃহস্পতিবার তার মুখপাত্রের এক বিবৃতিতে বলা হয়, আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালীতে যে সঙ্কট ঘনিয়ে উঠেছে তা নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উদ্বিগ্ন। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ নৌকায় আটকা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েকটি দেশ তাদের সীমানায় এসব নৌকা ঢুকতে বাধা দিচ্ছে বলে প্রতিবেদন এসেছে, যা নিয়ে মহাসচিব উদ্বিগ্ন। সাগরে বিপদগ্রস্তদের সহায়তা করতে এবং যারা আসছে ‘তাদের জোর করে ফিরিয়ে না দেয়ার নীতি’ সমুন্নত রাখতেও ওই অঞ্চলের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান বান কি-মুন।
অন্যদিকে, মাঝ সাগরে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ভাসতে থাকা প্রায় আট হাজার অভিবাসীর জীবন রক্ষায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশের সরকারের প্রতি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার জাইদ রাদ আল হোসেইন। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া কিছু অভিবাসীকে তীরে নামতে দেয়ায় তিনি এই দুই দেশের প্রশংসা করেন। কিন্তু একই সঙ্গে তারা যে অভিবাসীদের সাগরে ঠেলে দিচ্ছে তাতে এদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এদের জীবনকে আরো ঝুঁকির মুখে ঠেলে না দিয়ে আমাদের বরং উচিত তাদের জীবন রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া। তিনি বলেন, এই অভিবাসীরা যেখান থেকে যেভাবেই তাদের সীমান্তে আসুক না কেন তাদের অধিকারকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এদেরকে অপরাধী বলে গণ্য এবং কারাবন্দী করা সমস্যার সমাধান নয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গত তিন মাসে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে যাদের মধ্যে প্রায় তিনশ’ জন যাত্রাপথে মারা গেছে।
সমস্যার আঞ্চলিক সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সাগরের ভাসমান মানুষের জীবন বাঁচাতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস অফিসের পরিচালক জেফ রাথকি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উচিত তাদের তীরবর্তী ভেসে থাকা মানুষদের নামার সুযোগ দেয়া। তিনি জানান, সাগরে ভেসে থাকা এসব মানুষ উদ্ধারে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ নেই। এটি একটি আঞ্চলিক ইস্যু। এ ইস্যুর সমাধানে দ্রুত আঞ্চলিক পদক্ষেপ দরকার। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা এ অঞ্চলের মানুষদের একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানাই। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে তিনি এ আহবান জানান।
সমপ্রতি মালয়েশিয়ার সীমান্তের কাছে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের কিছু ক্যাম্প ও অভিবাসীদের গণকবর পাবার পর পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। থাই সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার পর কয়েকজন পাচারকারী ও অবৈধ অভিবাসী আটক হয়েছেন।
এ ঘটনার পর মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সরকারও তাদের সমুদ্রসীমায় নজরদারি বাড়িয়েছে। যে কারণে সাগরে ভেসে থাকা প্রায় আট হাজার অভিবাসী এখন কোনো তীরে ভিড়তে পারছে না। এসব নৌকায় পর্যাপ্ত খাবার ও পানি না থাকায় তাদের জীবন এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। থাইল্যান্ডের জলসীমায় একটি নৌকাতে যাত্রীরা মূত্র পান করে বেঁচে আছে বলে বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বলছে, ছয় হাজারেরও বেশি অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত অবৈধ অভিবাসী এখন উদ্ধারের অপেক্ষায় আছে।