ঢাকা: রাজনৈতিক কোন্দলকে কেন্দ্র করে উপসাগরীয় দেশ লেবাননে এক বাংলাদেশির হাতে খুন হয়েছেন আরেক প্রবাসী বাংলাদেশি। আর সেই খুনিকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে লেবানন পুলিশ।
এরই অংশ হিসেবে দেশটি থেকে ফিরতে চাওয়া সব বাংলাদেশিকেই বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কোনো উড়োজাহাজেই বাংলাদেশি শ্রমিক তোলা হচ্ছে না। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন ছুটিতে দেশে আসতে চাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
প্রবাসী কল্যাণ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়, গত রোববার রাতে বৈরুতে অনুষ্ঠিত শিল্পী মমতাজের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে এ খুনাখুনির ঘটনা ঘটে। পরদিন ফেরার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও শিল্পী মমতাজ এখনও লেবাননেই অবস্থান করছেন।
লেবাননের বৈরুতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
চিঠিতে জানানো হয়, ঘটনার দিন প্রায় মধ্য রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার হরষপুর গ্রামের শামসু শিকদারের ছেলে সজীব শিকদারকে (২৩) গুলি করে হত্যা করেন হানিফ ওয়াহেদ আলী নামের আরেক বাংলাদেশি।
এ সময় শিল্পী নামের আরেক নারী শ্রমিকও গুলিবিদ্ধ হন। তারা সবাই শ্রমিক হিসেবে দেশটিতে গিয়েছিলেন।
দূতবাস আরও জানায়, ওই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ লেবানন শাখা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে সজীব ও হানিফের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই কোন্দল চলছিল। এরইমধ্যে আহত শিল্পীকে নিয়েও তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়।
পরে সেখান থেকে ফেরার পথে বৈরুতের আয়নাল রুমানি এলাকায় এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হানিফ সজীবকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে মাউন্ট লেবানন হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
আর স্থানীয় সিন এল ফিল হাসপাতালে লেবাননের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর অধীনে (আইএসএফ) আহত শিল্পীর চিকিৎসা চলছে বল ওই চিঠিতে জানানো হয়।
এতে আরও বলা হয়, সন্দেহভাজন বাংলাদেশির ছবি দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে তার সন্ধানও চেয়েছে আইএসএফ। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে আহত শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে বৈরুতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিকে ধরতে কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু খুব বেশিদিন হয়তো এটি চলবে না।’
‘দু’একদিনের মধ্যেই লেবানিজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে,’ যোগ করেন তিনি।
এছাড়া লেবানন থেকে বাংলাদেশিদের ফেরার পরিমাণও প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য নয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে হানিফকে ধরতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের সভাপতি লুৎফর রহমান শ্যামলকে আটক করেছে লেবানন পুলিশ। তিনি হানিফকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলেও সন্দেহে করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানের দিন ঘটনা ঘটলেও এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শিল্পী মমতাজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনভাবেই জড়িত নয় বলে জানিয়েছে দূতাবাস সূত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ নেতা শ্যামলের অনুরোধেই শিল্পী মমতাজ লেবাননের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আর তাই শ্যামলকে আটকের পর মানবিক কারণেই এখনও দেশে ফেরেন নি তিনি। তবে দুই-একদিনের মধ্যেই মমতাজ দেশে ফিরবেন বলে জানিয়েছে ঢাকার একটি সূত্র।
এদিকে নিজেদের মধ্যে এভাবে অন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে যাওয়ায় লেবাননে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সম্পর্কেও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের রাজনীতি করার অনুমতি না থাকার পরও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না লেবানন।
‘এ ঘটনার পর সেদেশে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য আইন-কানুন আরও কঠোর করবে লেবানন প্রশাসন এটা ধারণা করাই যায়। কারণ শ্রমিকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে দেশটির প্রসাশন,’ বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বর্তমানে লেবাননে বাংলাদেশের প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক আছে জানিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজ, নিষ্ঠতা প্রভৃতিতে লেবানন কর্তৃপক্ষ সবসময় খুশি। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশি নানা অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও লেবাননে এই সংখ্যা মাত্র এক বা দুইজন। সে সুনাম নষ্ট হতে চলেছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া কিছু শ্রমিকের জন্য।
‘বিশ্বের বড় বড় বাজার যেখানে বন্ধ হতে বসেছে সেখানে ছোট্ট দেশ হলেও লেবাননে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। এ দেশের আইন-কানুনও বেশ কড়া। তাই অবশ্যই শ্রমিকদের এখানে আসার আগে সঠিকভাবে সচেতন করে পাঠাতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
লেবাননের একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লেবাননের আওয়ামী লীগ শাখা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত না হলেও তারা দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সরাসরি তাদের নিরুৎসাহিত করা হয় না। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারা কোনো সফরে গেলেও এসব শাখা আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।