বেপরোয়া সাইবার অপরাধীরা, ৮৩ ক্যাফে নজরদারিতে

Cyber_Crimeচট্টগ্রাম: নগরীর ৮৩টি সাইবার ক্যাফেকে নজরদারির আওতায় এনেছে পুলিশ। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) অনুমোদনবিহীন কোন সাইবার ক্যাফে নগরীতে আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ (সাইবার ক্রাইম) বেড়ে যাওয়ায় নগর পুলিশ এ ব্যবস্থা নিয়েছে।

পুলিশ সূত্রমতে, নগরীতে বর্তমানে যেসব অপরাধ ঘটছে তার মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশই হচ্ছে সাইবার অপরাধ। এ অপরাধের শিকার হচ্ছেন উচ্চশিক্ষিত অভিজাত নারী থেকে দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরী পর্যন্ত। অনেকে সামাজিকভাবেও বিপর্যস্ত হচ্ছেন। সামাজিক অবস্থান আছে এমন পরিবারের লোকজন হরহামেশাই সাইবার অপরাধের মুখোমুখি হচ্ছেন। সাইবার অপরাধে জড়িতদের অধিকাংশই তরুণ-যুবক।

সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধ বেড়ে যাবার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে নগর পুলিশকে। এ কারণে প্রথমবারের মত সাইবার ক্যাফেগুলোর দিকে নজর দিয়েছে পুলিশ।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি, সাইবার ক্যাফেগুলো থেকে অনেক অপরাধ হচ্ছে। অপরাধের জন্য ব্যক্তিগত ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ব্যবহার না করে সাইবার ক্যাফেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন সাইবার ক্যাফেগুলো বিটিআরসি’র নিয়ম মেনে চলছে কিনা সেটা আমরা দেখছি। ক্যাফেগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশও আমাদের নজরে থাকবে।

সাইবার ক্যাফে স্থাপন করতে হলে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট,২০০১ এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী বিটিআরসি থেকে আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) লাইসেন্স নিতে হয়। এক্ষেত্রে বিটিআরসি’র বেশকিছু শর্ত মানতে হয়।

বিটিআরসি’র শর্তের মধ্যে আছে, সাইবার ক্যাফে একটি অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং কমপক্ষে দু’টি ফোন ও একটি ই-মেইল ঠিকানা থাকতে হবে।

প্রত্যেক ব্রাউজারের (গ্রাহক) নাম-ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর নিবন্ধন বইতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

ব্রাউজারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার্থে ক্যাফের ভেতরে ছোট ছোট বুথ করা যাবে। তবে পার্টিশনের উচ্চতা হতে হবে সর্বোচ্চ চার ফুট এবং কোন ধরনের দরজা কিংবা প্রতিবন্ধকতা দেয়া যাবেনা। ক্যাফের ভেতরে অবশ্যই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থাকতে হবে।

বিদ্যালয় চলাকালীন স্কুলপোশাক পর‍া ছাত্রছাত্রীরা সাইবার ক্যাফে ব্যবহার করতে পারবেনা। তবে শিক্ষাগত প্রয়োজনে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকের অনুমতিপত্র নিয়ে সাইবার ক্যাফে ব্যবহার করা যাবে।

সাইবার ক্যাফের সামনে খোলা জায়গায় একটি অভিযোগবক্স থাকতে হবে।

সাইবার ক্যাফের ইন্টারনেট সংযোগ নিতে হবে অবশ্যই কোন আঞ্চলিক অথবা জাতীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠান থেকে যেটা বিটিআরসি অনুমোদিত। ইন্টারনেট সংযোগ কোন ধরনের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাবেনা। ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে পর্ণো ছবি কিংবা সাইট দেখা অবৈধ।

প্রত্যেক সাইবার ক্যাফেকে বছরে দু’বার ৩১ জানুয়ারি অথবা ৩১ জুলাই তাদের কার্যক্রমের প্রতিবেদন বাধ্যতামূলকভাবে তাদের লাইসেন্স অথরিটি অর্থাৎ বিটিআরসিকে দিতে হবে।

সূত্রমতে, অনুসন্ধানে পুলিশ জানতে পেরেছে, নগরীর সাইবার ক্যাফেগুলোর অধিকাংশই বিটিআরসি’র শর্ত অনুসরণ করেনা। অধিকাংশ ক্যাফে বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়। ভেতরে অন্ধকার, অপরিসর খুপচি বুথে পাশাপাশি রাখা হয় দু’টি চেয়ার। সিসি ক্যামেরাও নেই। নিবন্ধন করা হয়না ব্রাউজারদের।

বাধাবিঘ্ন ছাড়াই চলে পর্ণো সাইট ব্রাউজিং। অন্ধকার বুথের ভেতরে নিয়মিত অসামাজিক কার্যকলাপ চলে বলেও অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ যাতে জড়িত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীরা।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার (তথ্যপ্রযুক্তি) মো.জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আমরা পাই। ব্যক্তিগত শুত্রুতা কিংবা প্রেমের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে নগ্ন ছবি আপলোড করা, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা, ব্যক্তিগত জীবনের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, গোপনীয়তা লঙ্ঘনসহ অনেক অভিযোগ পাই। এর মধ্যে অধিকাংশ সাইবার অপরাধই সংঘটিত হচ্ছে ক্যাফেগুলোতে।

সহকারি কমিশনার জাহাঙ্গীর জানান, তিন ধাপে সাইবার ক্যাফে নিয়ে কার্যক্রম চালাবে পুলিশ। প্রথম ধাপ হচ্ছে সাইবার ক্যাফেগুলোর প্রতি নজরদারি বাড়ানো যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, প্রত্যেক সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে বিটিআরসি’র শর্ত মানছে কিনা সেটা তদন্ত করা এবং অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেয়া।

তৃতীয় ধাপ আছে, বিটিআরসি’র অনুমোদনবিহীন সাইবার ক্যাফেগুলো শনাক্ত করা এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়া।

তবে নগরীতে ৮৩টি সাইবার ক্যাফের একটি তালিকা তৈরি করে ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।

সূত্রমতে, ৮৩টি সাইবার ক্যাফের মধ্যে কোতয়ালি থানা এলাকায় আছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে মোমিন রোডে প্যারাগন সাইবার লিংক, ডিএনএস সাইবার লিংক ও মেঘদূতে সাইবার ক্যাফে, দেওয়ানবাজার সাবএরিয়া এলাকায় সাইবার কিং, ব্রাজিং হোম এবং দোস্ত বিল্ডিংয়ে কিউএমএস, জিএস, স্পিড ও এম এস ইন্টারন্যাশনাল।

চকবাজার থানা এলাকায় আছে ২৩টি। এগুলো হচ্ছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডে নেট লিংক, স্বপ্নীল ও ইনফোটেক, চট্টগ্রাম কলেজের আশপাশের এলাকায় কিংস কম্পিউটার এন্ড ট্রেনিং, অলওয়েজ, রেইনবো, আর এ ডটকম, মিডিয়াটেক, গ্রীণপিস ইন্টারন্যাশনাল, সাইবার ওয়ার্ল্ড, কন্ট্রাক্ট ডটনেট, সিমা টেকনোলজি, গ্লোবাল আইটি, 9AE কম্পিউটার এন্ড সাইবার, মেহেদিবাগে আইটি সাইবার, সেন্ট্রাল প্লাজায় সিস্টেম সলিউশন, সাইবার শট, ডটকম, নেট প্রো, ক্লিক সাইবার ক্যাফে, ক্লেপ নেট, সাইবার ভিলেজ ও ডটনেট।

চান্দগাঁও থানা এলাকায় আছে ৬টি সাইবার ক্যাফে। এগুলো হচ্ছে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ভেতরে ফিউচার নেট ও রাঙ্গুনিয়া সাইবার ক্যাফে, বহদ্দারহাট মোড়ে সুপার হাউস সাইবার ক্যাফে, হাজেরা তজু কলেজের আশপাশের এলাকায় সাইবার জোন এন্ড ডিজিটাল স্টুডিও, আছিয়া ট্রেডার্স ও জয়া কম্পিউটার এন্ড সাইবার ক্যাফে।

ইপিজেড থানা এলাকায় আছে ৮টি। এগ‍ুলো হচ্ছে কমপিউমি, লগইন ইন্টারনেট ক্যাফে, নাহার ভার্চুয়াল ক্যাফে, অনলাইন গেমস ক্যাফে, ক্লিক কম্পিউটার সেন্টার এন্ড সাইবার ক্যাফে, মুন্না প্লাজা ইন্টারনেট ক্যাফে, কম্পিউটার ভিশন ও ইজি কম্পিউটার।

খুলশী থানার লালখান বাজার মোড়ে এসবি এন্টারপ্রাইজ। তবে এটি সাময়িকভাবে বন্ধ আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।

পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ৯টি সাইবার ক্যাফে আছে। এর মধ্যে বাদুরতলায় সিটিহাট সাইবার ক্যাফে ও সৈয়দ সাইবার ক্যাফে, মুরাদপুরে এনএসএ সাইবার জোন, দুই নম্বর গেইটের আরএফ টাওয়ারে নেট ব্রাউজিং সেন্টার ও ইজিনেট, বিবিরহাটে স্পিড টাচ ও ভিশতা কম্পিউটার এবং হামজারবাগে বিসমিল্লাহ টেলিকম ও আই-টেক ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড।

পতেঙ্গা মডেল থানা এলাকায় আছে তিনটি। এগুলে‍া হচ্ছে, উত্তর পতেঙ্গায় কিম্পউটেক.নেট, কাটগড় এলাকায় টেলিনেট ও ডটনেট ওয়ার্ল্ড।

ডবলমুরিং থানা এলাকায় ৬টি সাইবার ক্যাফে আছে। এগুলো হচ্ছে দেওয়ানহাটে সায়েম সাইবার জোন, ত্রিডাকস টেকনোলজি, কালাম আইটি সেন্টার, আইটি জোন, মজিদ এন্টারপ্রাইজ এবং ক্যাপেটেরিয়া সাইবার জোন এন্ড স্টেশনারি।

হালিশহর থানা এলাকায় আছে ১১টি সাইবার ক্যাফে। এগুলো হচ্ছে বৌবাজার এলাকায় এইচ এ মোতালেব এন্টারপ্রাইজ ও সাইবার আড্ডা, পানির কল এলাকায় সাকিব ডটনেট, চুনা ফ্যাক্টরি মোড়ে মাইক্রো সলিউশন, বড়পুলে ‍সাইবার টাচ ও নান্দনিক, কে-ব্লকে বাউন্সার, এ-ব্লকে গাজী বিজনেস জোন, বি-ব্লকে সেঞ্চুরি এন্টারপ্রাইজ, থ্রী জেম এন্টারপ্রাইজ ও রিসোর্স কম্পিউটার।

আকবর শাহ থানায় আছে চারটি। এগুলো হচ্ছে, কর্ণেলহাটে এম কম্পিউটার এন্ড সাইবার ক্যাফে, জিএন সাইবার ক্যাফে, ক্লিক সাইবার ক্যাফে এবং উষা কম্পিউটার এন্ড সাইবার ক্যাফে।

বায়েজিম বোস্তামি থানায় আছে তিনটি। এগুলো হচ্ছে কুয়াইশ সড়কে মেঘনা কম্পিউটার, চাঁদনী সিনেমা হলের পাশে স্পিডি নেট আইটি এবং টেনারি বটতল এলাকায় একে ডটনেট আই সলিউশন।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, অলিগলিতে যে যেভাবে পারছে সাইবার ক্যাফে স্থাপন করছে। কোন নিয়মনীতি মানা হচ্ছেনা। এর ফলে সাইবার অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা চট্টগ্রামে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.