মেগা প্রকল্পে পাল্টে যাবে দেশের ছয় বিমানবন্দর।
দেশের ছয়টি বিমানবন্দরের চেহারা বদলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটি মেগা প্রকল্পসহ ১৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরুর সব প্রস্তুতি শেষ করেছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রকল্পগুলোর কাজ আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শেষ হবে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই বদলে যাবে বিমানবন্দরগুলোর চেহারা।
প্রকল্পগুলোর অন্যতম হল- ১৪ হাজার কোটি টাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকার কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ, ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জেনারেল হ্যাঙ্গার প্রতিস্থাপন, ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল এবং ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একই বিমানবন্দরের রানওয়ে ও রানওয়ে ওভারলেকরণ প্রকল্প, ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও রানওয়ে ওভারলেকরণ কাজ, ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ, ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর বিমানবন্দরের টার্মিনাল, ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন ও পার্কিং নির্মাণ প্রকল্প।
সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান বলেন, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই বদলে যাবে বিমানবন্দরগুলোর চেহারা। দেশ-বিদেশে সুনাম ছড়াবে এভিয়েশন খাত। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালনকারী সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী বলেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। দুই বছরের মধ্যে কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তখন বদলে যাবে সব বিমানবন্দরের চেহারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার প্রথম পর্যায়ের কাজ প্রায় শেষের দিকে। জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগেই এ বিমানবন্দরের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে অনুমোদনের জন্য ফাইল মন্ত্রণালয়ে আছে।
সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণের কাজও শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। বিদ্যমান রানওয়েকে শক্তিশালী ও প্রশস্তকরণের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য লাইটিং সিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ কাজের দরপত্র শেষে এখন কার্যাদেশ দেয়ার কাজ চলছে। রানওয়ের কাজ শেষ হলে এবং জ্বালানি ডিপো চালু হলে সিলেট থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেট করা যাবে। আগামী দুই বছরে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শাহজালালের মেগা প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের জন্য জেনারেল হ্যাঙ্গার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত এ টার্মিনালের জন্য যে জমি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে বর্তমানে ভিভিআইপি লাউঞ্জ ও জেনারেল এভিয়েশনের হ্যাঙ্গার রয়েছে। এগুলো হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি স্থানান্তর প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। হ্যাঙ্গার নির্মাণ শেষ হলেই শুরু হবে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ।
কক্সবাজার, যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবনের নির্মাণ কাজ ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হবে। বিশ্বমানের এসব টার্মিনালে আন্তর্জাতিক মানের সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে এবং এসব টার্মিনাল পরিচালনা শুরু হলে কক্সবাজার, যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়নে প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দেশের অন্যতম কর্মব্যস্ত এ বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক হাব করার লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে একটি টার্মিনাল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানকার বর্তমান ডিপারচার লাউঞ্জকে সংস্কার, কনভয় বেল্ট ও নতুন একটি অ্যারাইভ্যাল টার্মিনাল তৈরি করা হবে।
যশোর বিমানবন্দরে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি অত্যাধুনিক টার্মিনাল ভবন ও পার্কিং জোন নির্মাণের কাজ জুনে শুরু হবে। এরই মধ্যে এ কাজের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এক মাসের মধ্যে কার্যাদেশ দিয়ে জুনেই এ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ বিমানবন্দরে নতুন করে একটি দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। যেখানে থাকবে নতুন কনভয় বেল্ট, অ্যারাইভ্যাল ও ভিআইপি লাউঞ্জ। এখানে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটা পার্কিং জোনও নির্মাণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে কার্গো এপ্রোন নির্মাণ প্রকল্পের কাজের শতকরা ৬৫ ভাগ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার অপারেশন ও প্রকল্পগুলো দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শাহ আমানতের এ প্রকল্প শেষ হলে এখানে সুপরিসর দুটি বোয়িং ৭৭৭ বা ছোট তিনটি উড়োজাহাজ একত্রে পার্কিং করা সম্ভব হবে। এছাড়া এ বিমানবন্দরের রানওয়ে শক্তিশালী ও আধুনিকায়ন করার জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে আগামী সপ্তাহে।
২০১৫ সালে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে সরাসরি কার্গো পরিবহন নিষিদ্ধ করে। এতে বিমান বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সিএএবি কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষ ৮০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক নিরাপত্তা যন্ত্র ক্রয় করে। এর মধ্যে ছিল বিশ্বমানের ইডিএস সিস্টেম বা এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম। কার্গোতে ইডিএস ও আরএথ্রি এরিয়া সংযোজনের মাধ্যমে কার্গো স্ক্যানিং আরও নিখুঁত এবং সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত করা হয়।
নতুন ইডিএস সিস্টেম এবং প্রশিক্ষিত জনবল এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্গো নিরাপত্তা জোরদার হওয়ায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যসব দেশ কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। ৪০ কোটি টাকা মূল্যের ইডিএস মেশিন ক্রয়ের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমানের বার্ষিক আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া স্ক্যানিং চার্জের মাধ্যমে সিএএবি এর বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ কোটি টাকা। জাপানি দাতা সংস্থা জাইকার অনুদানের মাধ্যমে আগামী ৬ মাসের মধ্যে সংযোজিত হচ্ছে আরও দুটি ইডিএস মেশিন। এছাড়া দেশের বিমানবন্দরগুলো বিজ্ঞাপন, দোকান, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদির ইজারা প্রদানের মাধ্যমে সিএএবি কর্তৃপক্ষ গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) আয় করেছে ৫০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব। বকেয়া আদায়ের ব্যপারে সিএএবি কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থানের কারণে আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ।
বেবিচক সূত্র জানায়, প্রতি বছরই তাদের রাজস্ব আয় বাড়ছে। এর মধ্যে ২০১৬ থেকে ২০১৮ অর্থ বছরে শুধু বিজ্ঞাপন এবং বিজ্ঞাপনের ইজারা থেকে ১৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কর্তৃপক্ষের মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১৩১৯ কোটি টাকা। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১০৯৮ কোটি টাকা।