এভিয়েশন নিউজ: বাংলাদেশ বিমানের একজন বিতর্কিত ফাস্ট অফিসার ‘শামীম নজরুল’কে সন্তুষ্ট করতে না পারায় ৩ বছরের বেশি সময় ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে দেশের উদীয়মান ১৮জন ক্যাডেট পাইলটকে। অভিযোগ কোটি টাকার বেশি অর্থ খরচ আর জীবন বাজি রেখে যারা ক্যাডেট পাইলট হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন তাদের প্রতি ৩টি বছর ধরে চরম অবিচার করে যাচ্ছে বিমান।
অথচ বাংলাদেশ পাইলট এসোসিয়েশনের (বাপা) এক শীর্ষ নেতার জামাতা ও বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের এক শীর্ষ কর্মকর্তার আত্মীয় হওয়ায় ২ জন ক্যাডেট পাইলট বিমানে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু বাকী ১৮ জনকে দেখার কেউ নেই। এদের কারো কারো লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কেউ কেউ আত্মহত্যার করা ছাড়া বিকল্প নেই বলেও এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিমান যদি তাদের ব্যবস্থা না করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাস্তবায়ন করে তাহলে তারা আত্মহত্যা করবেন। এমনকি মামলাও করতে পারেন। অবিলম্বে তারা এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্থগিতের দাবি জানান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বৈমানিক সংকট বেশ কিছুদিন ধরেই। এই সংকট কাটাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকেও বৈমানিক আনা হয়েছে। অথচ নিয়োগ পেয়েও ৩বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে ৮ ক্যাডেট বৈমানিককে। আর দ্বিতীয় ব্যাচের ১০ জনের তো কোন খবরই নেই। এরইমধ্যে সম্প্রতি বিমান এয়ারবাস ৩১০ ও বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের জন্য বৈমানিক চেয়ে (ফাস্ট অফিসার) বিজ্ঞাপন দিয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এই সার্কুলারের মাধ্যমে ১৬ জন বৈমানিক নেওয়া হবে বলে বিমান সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বিমান ২০ জন ক্যাডেট বৈমানিককে নিয়োগ দেয় বিমান। এদের মধ্যে প্রথম ব্যাচের ১০ জন হলেন অনিতা রহমান (রোল-২৩), আতায়েব যোবায়ের জাফর (রোল-১৬), সাদাত জামিল (রোল-১০), ইন্তেখাব হোসাইন (রোল-৪৪), মোনজরিন রেয়ান (রোল-৭), মুনতাসির মাহবুব (রোল-২০), আবু মাসফিক (রোল-১), আবদুল হামিদ মেহেদী ( রোল-৩৭), নাসিইব রহমান নাফি (রোল-২২), সারওয়াত সিরাজ অন্তরা (রোল-১৮)। অপর দিকে দ্বিতীয় ব্যাচের ১০ জন হলেন, মোহাম্মদ শফিকুর রহমান (রোল-৪), মহসিন কামাল (রোল-১৫), এলিশ মাহমুদ ইমরান (রোল-১৪), মন্টি হাসান (রোল-২৫), রিশাখ বিন মনজুর (রোল-২), আরেফিন সাজিদুর রহমান (রোল-১১), সরফরাজ ইয়ামিন (রোল-৪৯), শাহী উদ্দিন আহমেদ ইজাম (রোল-১৯), মুজাহিদুল ইসলাম (রোল-২৮) ও মনজুরুল ইসলাম (৩)।
পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি পত্রে বলা হয়েছে প্রথম ব্যাচের ১০ জনকে বিমানে যোগদান এবং দ্বিতীয় ব্যাচের ১০ জনকে ওয়েটিং ফর ফারদার ডিসিশান হিসাবে রাখা হয়েছে। এরপরই বিমানের ট্রেনিং শাখায় যোগ দেন বিতর্কিত একজন ফাস্ট অফিসার ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল। কোন ধরনের যোগ্যতা না থাকার পরও বিএনপি আমলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদ জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দারের ঘনিষ্টভাজন হিসাবে পরিচিত ও কানাডার নাগরিক শামীম নজরুলকে সহকারী চীফ অব ট্রেনিং হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় বিমানে। মুলত এরপর থেকে এসব কাডেট পাইলটদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়।
শামীম নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডেট পাইলটদের সঙ্গে তার আন্ডারহ্যান্ড নেগোসিয়েশন না হওয়ায় সে নিজস্ব ক্ষমতা বলে এবং ম্যানেজমেন্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এসব মেধাবী পাইলটদের বছরের পর বছর বসিয়ে রেখেছে। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানাগেছে খোদ বিমান বোর্ডকে পর্যন্ত শামীম নজরুল নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডেট পাইলটদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম ব্যাচের ৪ জন ক্যাডেট পাইলটকে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্ত অভিযোগ আছে, শামীম নজরুল সংশ্লিষ্ট ট্রেনিং দাতা কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ইচ্ছাকৃত ভাবে ২ জনকে ফেল করিয়েছেন।
একজন মহিলা ক্যাডেট পাইলট সবগুলো ট্রেনিং কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করলেও রহস্যজনক কারণে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে না। অপর দিকে বাপার সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবের জামাতা হওয়ায় একজন ক্যাডেট পাইলটকে ট্রেনিংয়ে পাস করিয়ে ফ্লাইট পর্যন্ত করানো হচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত একাধিক ক্যাডেট পাইলট কাঁদতে কাঁদতে জানান, তারা বিষয়টি বিমান বোর্ড চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনকে জানাতে চান। কিন্তু অভিযোগ আছে, কোনভাবেই তার সাক্ষাত নিতে পারছেন না ক্যাপ্টেন শামীম নজরুলের কারনে। তাদের বিশ্বাস বোর্ড চেয়ারম্যানকে বিষয়টি বুঝাতে পারলে তাদের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এই অবস্থায় কেউ কেউ বলেছেন, যদি শিগগিরই কোন সুরাহা না হয় তাহলে তাদের আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প কিছু থাকবে না।
জানা গেছে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডেট পাইলটদের ৬ মাসের ট্রেনিং সম্পন্ন হয়। শুধুমাত্র সিমুলেটর ট্রেনিংসহ দুই মাসের ট্রেনিং হলেই এরা ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাবেন। সেই অবস্থায় ১০ জনের মধ্য থেকে ৪ জনকে সিমুলেটরে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে দুইজন ফেল করে। বাকি দুইজন উত্তীর্ণ হয়ে এরই মধ্যে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। অভিযোগ আছে, দুইজন ফেল করেছে বাকিরাও ফেল করবে এই অজুহাত দিয়ে বাকিদের আর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়নি। যদিও ফেল করা দুই ক্যাডেট পাইলটের ফেলের নেপখ্যে বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের অভিযোগ আছে। আর এই নেপথ্যে পাইলটের ভুমিকায় কাজ করেছে শামীম।
বিমানের একজন বৈমানিক এভিয়েশন নিউজকে বলেন, বিমানের বৈমানিকদের এ ধরনের ফেল করার নজির নতুন নয়। বর্তমানে কর্মরত বেশিরভাগ বৈমানিক একাধিকবার ফেল করার পরও বিমান নিজ খরচে তাদের ট্রেনিং করিয়েছেন। এসব কারণে দুদকে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। পরবর্তীতে তারা পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বিমানে চাকরি করছেন। অথচ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই এরাও ফেল করবে- এ ধরনের ঠুঁনকো অজুহাতে ৮ বৈমানিককে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা প্রতি মাসে বেতনও পাচ্ছেন। কিন্তু অজানা কারণে তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আর দ্বিতীয় ব্যাচের ১০ জনের তো কোন খবরই নেই।
জানা গেছে, নিয়োগ প্রাপ্ত প্রথম ব্যাচের এই ক্যাডেট ৮ বৈমানিক সিমুলেটর ট্রেনিং পাঠানোর জন্য পে-অর্ডার দিয়ে যেতে রাজি হন। যদি তারা সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে ফেল করেন তাহলে তারা ট্রেনিং বাবদ খরচ হওয়া অর্থ ফেরত দিয়ে বিমান থেকে বিদায় নেওয়ার অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই বিমানের কর্তাব্যক্তিদের এই বৈমানিকদের প্রতি মন গলেনি। বিশেষ করে টেনিং বিভাগের গডফাদার শামীম নজরুলের।
অভিযোগ আছে, বড় ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিজের কিছু বন্ধু বান্ধরকে বিমানের ক্যাডেট পাইলট হিসাবে ঢুকানোর জন্যই নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। বিমানের একজন কেবিন ক্রুর স্বামী ও শামীম নজরুলের ঘনিষ্ট বন্ধু পলাশ নেপথ্যে থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে নতুন করে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ দেয়ায় পাঁয়তারা করছে।
এর আগে এই বিতর্কিত পলাশ হজের জন্য ও দ্বিতীয় দফায় নিজস্ব ফ্লিটের জন্য কেবিন ক্রু নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগ দিতে না পারায় কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে পালিয়ে ছিল। এখন সর্বশেষ কেবিন ক্রু নিয়োগ নিয়েও পলাশ গড়ে কেবিন ক্রু প্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ দেয়ার নাম করে এই অর্থ নেয়া হচ্ছে বলে বিমান জানতেও পেরেছে।
অভিযোগ রয়েছে বিমান বোর্ড চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনের নাম ভাঙ্গিয়ে পলাশ এসব অপকর্ম করছে। যদিও বিমান চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেছেন, পলাশের সঙ্গে তার কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। তাকে তিনি চেনেনও না। তিনি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান। এছাড়া বিমানের কতিপয় কর্মকর্তা ও পরিচালকের কক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা এই পলাশ আডাডা দিচ্ছে বলেও তার কাছে খবর আছে বলে জানান। এদের বিরুদ্ধেও খোঁজ খবর নেয় হবে।
জানাগেছে, বিমানে এই সময়ে ৮০ থেকে ১২০ জনের বেশি বৈমানিক প্রয়োজন। বৈমানিক না থাকায় এখন বিদেশ থেকে ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার মার্কিন ডলার বেতন দিয়ে বিদেশি বৈমানিক আনা হয়েছে। সেখানে দেশীয় একজন বৈমানিক পান মাত্র ৭ থেকে ৮ হাজার মার্কিন ডলার। এ ব্যাপারে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন পরিচালক ক্যাপ্টেন ইশরাত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাইলে বসে থাকা এসব ক্যাডেট বৈমানিকেরা এবার আবেদন করতে পারবেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাদের নেওয়া হবে।
এরা একবার পরীক্ষা দিয়ে ৬ মাস ট্রেনিং করে আবার কেন পরীক্ষা দেবে প্রশ্ন করা হলে ক্যাপ্টেন ইশরাত বলেন, এবারের বিজ্ঞাপনে এক হাজার ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। আগের নিয়োগ পাওয়াদের ফ্লাইং আওয়ার কম ছিল। বিমান সূত্রে জানা গেছে, বসে থাকা ক্যাডেটদের মধ্যে অনেকেরই ৫০০ ঘণ্টার বেশি ফ্লাইং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর এদের প্রত্যেকেরই ১৫০ ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা আছে।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের একজন বৈমানিক বলেন, বিশ্বের সব এয়ারলাইন্সেই ১৫০ থেকে ২০০ ঘণ্টা ফ্লাই করা বৈমানিকদেরই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বোয়িং ৭৩৭ কিংবা এয়ারবাসের মতো উড়োজাহাজের ফার্স্ট অফিসার হিসেবে উপযুক্ত করে তোলা হয়। এজন্য বোয়িং কোম্পানি কিংবা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) এর সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে।
কম ঘণ্টা ফ্লাই করা ক্যাডেটদের রুট ট্রেনিংয়ে ২০ ঘন্টার জায়গায় ২৫/৩০ ঘন্টা এবং ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম করালেই তারা বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের ফার্স্ট অফিসার হতে পারে। কিন্তু এই ১৮ বৈমানিককে সেই সুযোগ না দিয়ে নতুন করে করে রহস্যজনক কারণে আবারো বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। ক্যাডেট বৈমানিকদের মাঝপথে ট্রেনিং বন্ধ করে বসিয়ে রাখার এ ধরনের নজির বিশ্বের কোথাও নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জানাগেছে নতুন করে দেয়া এই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে শিগগিরই হাইকোর্টে মামলা দয়ের করা হতে পারে।