মানব পাচারকারীদের জালিয়াতিতে ট্যুরিস্ট (পর্যটন) ভিসা হয়ে যাচ্ছে এমপ্লয়মেন্ট (চাকরি) ভিসা। সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় ট্যুরিস্ট ভিসাকে এমপ্লয়মেন্ট ভিসা হিসেবে দেখিয়ে বহির্গমন ছাড়পত্র, স্মার্ট কার্ড বানিয়ে ফেলছে চক্রটি। আবার স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণও নেওয়া হচ্ছে। আর ঋণ শোধ করার দায় পড়েছে পাচারের শিকার অসহায় ব্যক্তিদের ওপর।
ফরিদপুরের সদরপুরের বাসিন্দা মো. ইলিয়াস (পাসপোর্ট নম্বর এডি২২৮৪৯৬৪)। তিনি ইরাক যেতে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন রাজ ট্রাভেলের জাহাঙ্গীর হোসেনকে। নির্ধারিত সময়েই তিনি ভিসা পান। তবে চাকরির ভিসা নয়, তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা। কিন্তু ইলিয়াস জানতেন না, শুধু ইরাকে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছেন তিনি এই ভিসায়।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশে চাকরি বা কাজ করতে হলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক কর্মীকে দেওয়া হয় স্মার্ট কার্ড। সেই কার্ডে কর্মীর সব ব্যক্তিগত পাসপোর্ট ও ভিসার তথ্য সংরক্ষিত থাকে। শুধু চাকরির ভিসা পেয়েছেন এমন কর্মীদের স্মার্ট কার্ড ইস্যু করে বিএমইটি। ইলিয়াসের স্মার্ট কার্ড নম্বর আইকিউ-আই-২০১৩-০০৬৯৯৯০০। বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার নিয়মকানুন জানা থাকায় স্মার্ট কার্ড পাওয়ার পর ইলিয়াস আশ্বস্ত হন আসল ভিসাতেই তাকে পাঠানো হচ্ছে।
ইলিয়াসের মতো আরও ২১ জন যুবক ছাড়পত্র ও স্মার্ট কার্ড নিয়ে ইরাকের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছেন। ইরাকের নাজাফ বিমানবন্দরে নেমে তারা জানতে পারেন, চাকরি নয়, তাদের ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয়েছে। ভিসার মেয়াদ আছে আর একদিন। যে স্মার্ট কার্ড ও ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তা ভুয়া। বিমানবন্দরে ২২ যুবক স্মার্ট কার্ড মিলিয়ে দেখেন, তাতে একই কর্মকর্তার নাম থাকলেও প্রতি কার্ডের স্বাক্ষর ভিন্ন। জমি বিক্রি করে ইরাক যাওয়ায় দেশে ফিরে আসার পথও বন্ধ। নাজাফ বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় দালালরা ইলিয়াসদের নিয়ে যায়। আট মাস বন্দিজীবনের পর ইরাকের বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে আসেন তারা।
ইলিয়াস, নরসিংদীর বিল্লাল, নওগাঁর ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকদের ইরাকের বন্দিশালায় পাচারের শিকার অন্যদের মতোই মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করা হয়। কয়েক দিন তাদের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। নির্যাতন ও বঞ্চনার গল্প পুরনো হলেও তাদের বিদেশ পাঠানোর প্রতারণার ধরন ও কৌশল নতুন। ইলিয়াস জানালেন, এখনও চলছে প্রতারকদের তৎপরতা। ১৮ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতারিত ইলিয়াসরা ক্ষতিপূরণ পাননি। তিনটি রিত্রুক্রটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করে বিপদ আরও বেড়েছে। এখন নিজেরাই মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারপর রয়েছে মাথায় ব্যাংক ঋণের বোঝা। দালালরা ১১ জনের নামে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক থেকে জনপ্রতি ৮০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়েছে। এ খবর জানতেন না ইলিয়াসরা। সব হারিয়ে দেশে ফেরার পর জানতে পারেন, এই ঋণ তাদেরই শোধ করতে হবে।
ইরাক থেকে ২২ যুবককে দেশে ফিরিয়ে আনারও সহায়তা করে ‘অনির্বাণ সারভাইভার ভয়েস’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। এর সমন্বয়ক আল আমিন নয়ন, প্রতারিতদের স্মার্ট কার্ডগুলো এই প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, এর প্রতিটিতে ভুয়া তথ্য দেওয়া হয়েছে। ট্যুরিস্ট ভিসাকে চাকরির ভিসা
হিসেবে দেখানো হয়েছে। অস্তিত্ব নেই এমন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্র দেখিয়ে বিএমইটি থেকে স্মার্ট কার্ড বানিয়েছে প্রতারকরা।
আল আমিন নয়ন বলেন, এর সঙ্গে বিএমইটির কর্মকর্তারাও জড়িত। তাদের সহায়তা ছাড়া কারও পক্ষে স্মার্ট কার্ড বানানো সম্ভব নয়। প্রতিটি কার্ডে বিএমইটির সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সই রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে বিএমইটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বৈধ এমপ্লয়মেন্ট ভিসা ছাড়া স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ ট্যুরিস্ট ভিসায় স্মার্ট কার্ড দিয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে কোনো না কোনো জালিয়াতি হয়েছে।’ মন্ত্রী নিজেও মনে করেন, ট্যুরিস্ট ভিসায় স্মার্ট কার্ড ও ব্যাংক ঋণ নেওয়ার কাজে শুধু রিত্রুক্রটিং এজেন্সি নয়, এর সঙ্গে কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজ-খবর করা হবে, দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় চারটি রিত্রুক্রটিং এজেন্সি মর্নিং সান, মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আইডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও ইস্ট বেঙ্গল ওভারসিজের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। তবে কোনো কর্মকর্তার বড় ধরনের শাস্তি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা সভাপতি আবুল বাশার সমকালকে বলেন, এজেন্সিগুলোর জামানতের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রতারিতদের সহায়তাকারী অনির্বাণের আল আমিন নয়ন সমকালকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বিদেশগামীদের ঋণ দিতে ব্যাংক যাচাই করবে ভিসা আসল না ভুয়া। এসব ক্ষেত্রে যাচাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়েছে। যাচাই হলে তখনই ধরা পড়ে যেত, এগুলো চাকরির ভিসা নয়। আমাদের ধারণা, ব্যাংকের লোকজনও রিত্রুক্রটিং এজেন্সির সঙ্গে জড়িত আছেন। কিন্তু ব্যাংক আমাদের কোনো বক্তব্যই আমলে নিচ্ছে না।’