‘বাজেট উচ্চাভিলাষী ও গণবিরোধী’
আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে উচ্চাভিলাষী ও গণবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি।
দলটি বলেছে, বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এই বাজেটে সাধারণ জনগণের জন্য কিছু রাখা হয়নি। এর মাধ্যমে ধনী শ্রেণীকে আরও ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অথচ সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার জনগণকে বাইরে রেখে যেভাবে নির্বাচন করেছে, একইভাবে বাজেটও দিয়েছে। এ নিয়ে জনমনে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থে বাজেট দিয়েছে।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে শুক্রবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বিএনপি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
জনগণের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে এই বাজেট দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এ বাজেট জনগণ মেনে নেয়নি। তারা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
লিখিত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাজেটের আকার বড় করার চমক সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেট বৃদ্ধির এ প্রবণতা বছর শেষে চুপসে যেতে দেখা যায়। কেননা প্রত্যেক বছরের শেষদিকে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ যেভাবে কাটছাঁট করা হয় তাতে বিরাট আকার বাজেটের অন্তঃসারশূন্যতাই প্রকাশ পায়।
‘ব্যয়ের আকাক্সক্ষা থাকলেও সরকারের আয়ের সামর্থ্য কমে গেছে’ মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা ও নাজুক আর্থিক খাত। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা করা হয়েছে। যদিও অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) এনবিআর আদায় করতে পেরেছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩ মাসে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হয় কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে যা নেতিবাচক বলেই মনে হয়।
তিনি বলেন, এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। বর্তমানে যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে তাতে ঘাটতি বরং আরও বাড়বে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, মোট রাজস্বের বড় অংশ হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। নতুন আইনে ভ্যাটের স্তর থাকবে ৫টি। এই স্তরভিত্তিক ভ্যাট হার অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা রেয়াত নিতে না পারলে এটি আবগারি শুল্কের মতো হয়ে যেতে পারে। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যার চাপ পড়বে সম্পূর্ণ ভোক্তার ওপর। এছাড়া ব্যবসায়ীদের রেয়াতের টাকা কিভাবে দেয়া হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা রেয়াত চাইতে শুরু করলে সরকারকে নিজের পকেটের টাকা দিতে হবে। এ জন্য বছরে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ফলে দেশের গুণগত সার্বিক রূপান্তরে অত্যধিক প্রয়োজনীয় মানব পুঁজি বা দক্ষ শ্রমশক্তি বিনির্মাণে, তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। উপরন্তু ঋণের পরিমাণ সুদসহ জমতে জমতে পাহাড়সম হলে পরিশোধের কোনো দিকনির্দেশনা এই বাজেটে নেই। বলা বাহুল্য, এর দায়ভার কিন্তু চাপবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাজেট ঘাটতি মেনে নেয়া যায়, যদি তা অর্থনীতিতে গুণক প্রভাব তৈরি করে। ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ সরকারি চাকরিতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি, গণহারে পদোন্নতির মাধ্যমে বেতন কাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। এ অর্থবছরে বেতন-ভাতার জন্য রাজস্ব ব্যয়ের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিযুক্ত বলা যাবে না।
এডিপিতে বরাদ্দকৃত ব্যয় কতটা গুণসম্পন্ন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বারবার সংশোধনের ফলে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচও চোখে পড়ার মতো। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চার লেন সড়ক তৈরিতে যেখানে ভারতে ১১-১৩ লাখ ও চীনে ১৩-১৬ লাখ ডলার খরচ হয়, সেখানে বাংলাদেশে ৫০ লাখ ডলারের বেশি। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশ দুর্নীতির যে খবর জনসম্মুখে এসেছে তাকে হিমবাহের চূড়া বলা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকল্পে কোন পর্যায়ের দুর্নীতি হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া অর্থবছর শেষে জোড়াতালি দিয়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৯০-৯২ শতাংশ দেখানো হয়, যা প্রথম ১০ মাসের হিসাবের সঙ্গে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
‘একদিকে বিশাল অঙ্কের বাজেট অন্যদিকে টাকাশূন্য ভল্ট। একদিকে ব্যয়ের ব্যাপক আয়োজন, অন্যদিকে টাকার জন্য ব্যাপক হাহাকার’- এমন মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এরকম বিপরীত অবস্থার মধ্যে দাবি করা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে দাঁড়াবে। অথচ ব্যাংক খাতে প্রাণ নেই। বিনিয়োগের জন্য নেয়া শিল্প ঋণ যেখানে পুরোটাই ব্যাংক খাতনির্ভর সেখানেই চলছে তীব্র অর্থ-সংকট। সবার মনেই প্রশ্ন, তা হলে ব্যাংকের এত টাকা গেল কোথায়? ঋণের টাকা ফেরত আসছে না ব্যাংক খাতে। খেলাপি ঋণ কেবল বাড়ছেই। প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ার ফলে স্বল্পমেয়াদি আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে, যা আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। বেশি সুদ ও কর ছাড়ের কারণে সবাই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছে।
‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি’- এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও হতাশ কৃষক ধানের ন্যায্য দাম না পেয়ে ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসা, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়া, ফি বছর বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণেও উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, সোনার দাম কমানো হয়েছে, যা ব্যবহার করে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী। অথচ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ- সেই মোবাইল, সিম ও সার্ভিসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সিগারেটের ওপর শুল্ক না বাড়ায় সিগারেট কোম্পানির ৩১% আয় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে! অথচ সারা বিশ্বে সিগারেট নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ এক শুভঙ্করের ফাঁকি।
বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতি বছরই বাজেটে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখিতা। বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।
সরকারের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছে না মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, কারণ সরকারই জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় এবং এর ফলে জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতাও নেই। অনির্বাচিত সরকারের বাজেট দেয়ার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, এই বাজেট সারা বছরে সরকারের ব্যর্থতার দলিল। এর মাধ্যমে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, তার সত্যতা নিয়ে মারাত্মক প্রশ্ন আছে।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যখন কোনো অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়। এ সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থে বাজেট দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।