এভিয়েশন নিউজ: বহরে একের পর এক জ্বালানিসাশ্রয়ী নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ। বেড়েছে গন্তব্য এবং যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা। এত কিছুর পরও লোকসান সামাল দিতে পারছে না বিমান। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের লোকসান গত অর্থবছরের মোট লোকসানকে ছাড়িয়ে গেছে। নাখোশ বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। লোকসানের কারণ চিহ্নিত করতে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দেন তিনি। অবশেষে পাঁচ কারণ চিহ্নিত করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার বিমান মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে লোকসানের পাঁচ কারণ চিহ্নিত করে রিপোর্ট জমা দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
গত অর্থবছরে (২০১২-১৩) লোকসান ছিল ১৯৩ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২২২ কোটি টাকা। বিমান বহরে ছয়টি বোয়িং-৭৭৭ যুক্ত হওয়ার পর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই ‘১৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ‘১৪) বিমানের যাত্রী পরিবহনক্ষমতা কমে গেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের ওই আট মাসে বিমান যাত্রী পরিবহন করে ১১ লাখ ৭৭ হাজার। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে এ সংখ্যা কমে হয়েছে সাড়ে নয় লাখ।
রিপোর্টে বিমানের অব্যাহত লোকসানের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যকে। বলা হয়েছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বিমানের জ্বালানি খরচ ছিল মোট পরিচালন ব্যয়ের ৪৭ শতাংশ। এই জ্বালানি তেলের ৪৬ শতাংশ দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করে বিমান। আর দেশে জ্বালানি তেলের দাম ৩১ শতাংশ বেশি। বিমানের পক্ষ থেকে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে পুরনো উড়োজাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়কে। আর অবচয় খরচকে বলা হয়েছে তৃতীয় কারণ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিমানবহরে নতুন উড়োজাহাজ সংযোজনের ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৮৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অবচয় হয়েছে। নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণের ফলে সুদ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধিকে চতুর্থ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম কারণ হচ্ছে, সংকুচিত রুট নেটওয়ার্ কের কারণে ফ্লাইটের লাভজনকতার ওপর ওভারহেড ব্যয়ের চাপ বৃদ্ধি।
বছরের পর বছর শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েও দিব্যি ‘রাজার হালে’ টিকে আছে সংস্থাটি। অপচয়ের কোনো কমতি নেই। নিউইয়র্ক, ম্যানচেস্টার, টরন্টো, বাইরাইন ও করাচির মতো রুটে বছরের পর বছর বিমান না চললেও অফিস ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বর্তমানে বিমানে প্রয়োজনের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি জনবল রয়েছে। তার পরও ওভারটাইম পরিশোধ করা হচ্ছে মূল বেতনের দ্বিগুণের মতো। পোলট্রি, ক্যাটারিংয়ের মতো কিছু সহযোগী ব্যবসা একসময় লাভজনক থাকলেও এখন লোকসানি হয়ে পড়েছে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে সংস্থাটিতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা।
১৯৯০ সালের পর বিমানের লোকসানের প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে গত ১৮ বছরে বিমান লাভের মুখ দেখেছে মাত্র চার বছর। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে লাভ করেছিল বিমান। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিমানের সাবেক প্রধান জামাল উদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। এর পর আবার লোকসানে যায় বিমান। গত চার অর্থবছরে যথাক্রমে ৪৬ কোটি, ১৯৯ কোটি, ৬০৫ ও ১৯৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
দীর্ঘদিন লোকসানের কারণে ২০০৬ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, জাপানের নারিতা, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারসহ আটটি গন্তব্যে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। এসব ফ্লাইট আবার চালু করা হচ্ছে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই। ফ্রাঙ্কফুর্ট ফ্লাইট চালু করা হয় গত ৩১ মার্চ। ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েও ৪১৯ আসনের উড়োজাহাজের প্রথম ফ্লাইটে বিক্রি হয় মাত্র ২৯টি টিকিট। আর ফিরতি ফ্লাইটে টিকিট বিক্রি হয় ৫৯টি। ৪ এপ্রিল দ্বিতীয় ফ্লাইটে মাত্র ১৬ জন যাত্রী ছিলেন। একইভাবে সদ্য চালু করা ইয়াঙ্গুন, দিলি্ল, ম্যানচেস্টার ফ্লাইটেও পর্যাপ্ত যাত্রী নেই।
বিমানের পরিচালক মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও রোমে প্রত্যাশিত যাত্রী পাওয়া না গেলেও লন্ডন, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়ালালামপুর গন্তব্যে বেশ যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইয়ারস, অনলাইনে টিকিট বিক্রিসহ কিছু কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। আরও কিছু সফটওয়্যার চালুসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচারের উদ্যোগসহ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। জুলাই-আগস্ট নাগাদ এসবের ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, এখন বিমান বহরে আধুনিক উড়োজাহাজ যেমন বেড়েছে, এর গন্তব্যের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই বিমানের লোকসান বাড়ার কথা নয়; বরং আগের চেয়ে কমে আসার কথা। বিমানের লোকসানের কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। লোকসান কাটিয়ে উঠতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
সমকালের সৌজন্যে।