বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে আলোচনায় যারা

বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে আলোচনায় যারা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘অবিশ্বাস্য’ বিপর্যয়ের পর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে বিরাজ করছে রাজ্যের হতাশা। ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে নির্বাচনে ফল বর্জন করার পর নতুন নির্বাচন দাবিতে কর্মসূচি দিতে ব্যর্থতা, একাদশ নির্বাচন বয়কট করে সেই সংসদে দলীয় এমপিদের যাওয়া, দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তি না পাওয়া, তার মুক্তির দাবিতে কোনো আন্দোলন কর্মসূচি না দেয়া, আগামী দিনে দলের করণীয় নির্ধারণে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব, নেতাকর্মীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারাসহ নানা কারণে কেন্দ্রের প্রতি তৃণমূলের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে। এসবের জন্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যর্থতাকেই দুষছেন দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী।

বিভিন্ন সময়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দৃঢ়তা ও অদূরদর্শিতার কারণে দলটির সাংগঠনিক ভিত দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের। এ অবস্থা থেকে দলকে বের করে আনতে উদ্যোগী হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। আপাতত দল গোছানোর লক্ষ্যে দ্রুত মূল দল পুনর্গঠন এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কাউন্সিল করতে চাইছে হাইকমান্ড।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ায় দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী দিনে রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য যা করা দরকার, সেই উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। সে জন্য সাংগঠনিকভাবে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূন্য দুই পদে দুই নেতাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত বুধবার সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে এই দুই পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি থাকায় দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গঠনতন্ত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে এ নিয়োগ দেন।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭(খ)(৬) উপধারায় ‘চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি এবং বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিসমূহের শূন্যপদ পূরণ করতে পারবেন।’
স্থায়ী কমিটির বাকি শূন্যপদগুলোও পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই পদগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতি করে আসা পোড় খাওয়া বেশ কয়েকজন নেতার নাম আলোচনায় আসছে। শূন্য দুই পদ পূরণ হওয়ার পর প্রবীণ নেতাদের কেউ কেউ কিছুটা অভিমান নিয়ে বসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে দলে গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও স্থান না হওয়ায়। আবার অনেকে হাইকমান্ডের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন যেই বাকি শূন্যপদে তাদের নাম বিবেচনা করা হয়।
বিএনপিতে স্থায়ী কমিটি বরাবরই একটি আকর্ষণীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন পদ। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করা পোড় খাওয়া নেতাদের টার্গেট থাকে শেষ জীবনে হলেও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এ ফোরামে সাংগঠনিকভাবে যোগ্য, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দলে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই স্থান হয়। তাই প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া।
এ কমিটি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত, কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজগুলো করে। স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকেই বেশিরভাগ সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে।
কমিটি ঘোষণার সময়ই ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির দুটি পদ ফাঁকা ছিল। বাকি ১৭ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। তারা হলেন- দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান) তারেক রহমান, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর মধ্যে তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার মারা যাওয়ায় আরও তিনটি পদ শূন্য হয়।
সম্প্রতি নতুন দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করায় কমিটির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬-তে। ফাঁকা রয়েছে আরও তিনটি পদ। পুরনোদের মধ্যে লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থতার কারণে নিয়মিত সময় দিতে পারছেন না। তারা স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকে কদাচিৎ অংশ নিচ্ছেন। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কমিটি ঘোষণার আগে থেকেই ভারতের শিলংয়ে আছেন। তিনি কমিটির একটি বৈঠকেও যোগ দিতে পারেননি।
একটি সূত্র বলছে, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন। এ নিয়ে ওই দুই নেতা তাদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথাও বলেছেন।
সব মিলিয়ে স্থায়ী কমিটিতে ৫ পদ ফাঁকা হচ্ছে। এসব পদ শিগগিরই পূরণ করা হতে পারে।
স্থায়ী কমিটির একটি পদে জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমানের অন্তর্ভুক্তির দাবি রয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ায় ক্লিন ইমেজের ডা. জোবায়দা দলকে গোছাতে পারবেন বলে ধারণা অনেকের। যদিও এ বিষয়ে জিয়া পরিবার কিংবা বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো নেতা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তাই অনেকে ধরেই নিয়েছেন জোবায়দা রহমানের এ মুহূর্তে স্থায়ী কমিটিতে আসার তেমন সম্ভাবনা নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বাকি শূন্যপদগুলোতে আসতে পারেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও মোহাম্মদ শাহজাহান।
এদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল নোমান ও আবদুল আউয়াল মিন্টু জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ। তারা বিভিন্ন সময়ে দলের আস্থার মূল্য দিয়েছেন।
গতবার কাউন্সিলের আগেই স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনায় ছিলেন প্রবীণ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। এ দুজনকে এবার স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে দেখা যেতে পারে।
বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন স্থায়ী কমিটিতে আসুক এমনটি চাওয়া অনেকের। খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম এ সদস্য ইতিমধ্যে আস্থা অর্জন করেছেন বিএনপি নেতাদের কাছে। বিগত দিনে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে বিএনপির হয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন।
এ ছাড়া অপর আইনজীবী নেতা সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সহসভাপতি ও দলের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনও গত কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোরালো আলোচনায় ছিলেন। এখন তার নামটিও আলোচনায় রয়েছে।
গত কাউন্সিলে আলোচনায় ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও ড. ওসমান ফারুক। এ দুজনই এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাই শূন্যপদে তাদের কারোরই অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা নেই।
চট্টগ্রামের প্রবীণ বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খান ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত। তাদের কোনো একজনকে দেখা যেতে পারে স্থায়ী কমিটিতে। বয়সের কারণে মোরশেদ খান বাদ পড়লেও মোহাম্মদ শাহজাহানের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
এ যাবৎকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটিগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন কোটায় নেতাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- নারী, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী, বিভাগ ইত্যাদি।
সদ্য পদোন্নতি পাওয়া সেলিমা রহমান কোন কোটায় স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন নেতারা। তাকে বরিশালের কোটায় স্থায়ী কমিটিতে নিয়োগ দেয়া হলে এ বিভাগের অন্য কারও এই পদে আসার সম্ভাবনা নেই। তবে তাকে নারী কোটায় স্থায়ী কমিটিতে নেয়া হলে এ বিভাগে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন ও ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তমের মধ্য থেকে একজন কিংবা দুজন জায়গা পেতে পারেন স্থায়ী কমিটিতে। শেষের তিনজন আবার আইনজীবী কোটায়ও পড়েন।
ময়মনসিংহ বিভাগের নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান এজেডএম জাহিদ হোসেনের নামও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচনায় রয়েছে। এ বিভাগের ড. এম ওসমান ফারুক দেশে থাকলে তিনি এ পদের জন্য বিবেচিত হতেন।
কেউ কেউ বলছেন, কেএম ওবায়দুর রহমান ও অ্যাডভোকেট মাহবুব হোসেনের মৃত্যুর পর বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে কাউকে দেখা যায়নি স্থায়ী কমিটিতে। এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে স্থায়ী কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার সম্ভাবনায় রয়েছেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ।
এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে বলেন, স্থায়ী কমিটিতে বাকি যে শূন্যপদ আছে, সেগুলোও পূরণ করা উচিত। তাদের দলে উপযুক্ত ও যোগ্য নেতা রয়েছে, সেহেতু এসব পদ পূরণে কোনো সমস্যা নেই। এতে করে কাজ করতেও সুবিধা হয়। শূন্যপদগুলো পূরণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো নেতা অসুস্থ থাকতে পারেন, বিদেশে যেতে পারেন। এ কারণে তাদের বৈঠকে কোরাম সংকটের সৃষ্টি হয়। যদি এই পদগুলো পূরণ হয়, তা হলে এই সংকট আর থাকবে না।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.