‘ড্রোন আমদানিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে’
প্রযুক্তির উত্কর্ষের ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে ড্রোনের ব্যবহার। এর পরিপ্রেক্ষিতে মনুষ্যবিহীন এসব উড়োযানের আমদানি, উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী, খেলনা ব্যতীত অন্য ড্রোন আমদানিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি ড্রোনের জন্য আলাদা করে করতে হবে বীমা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত কাজে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ায় এ নীতিমালা করা হচ্ছে। নীতিমালাটি ‘ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা-২০১৯’ নামে অভিহিত হবে। খসড়া নীতিমালায় ব্যবহারের ভিত্তিতে ড্রোনকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। বিনোদনের জন্য ব্যবহূত ড্রোনকে ‘ক’ শ্রেণী, শিক্ষা ও গবেষণার মতো অবাণিজ্যিক কাজে ব্যবহূত ড্রোনকে ‘খ’ শ্রেণী; সার্ভে, ছবি তোলা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ইত্যাদি বাণিজ্যিক ও পেশাদার কাজে ব্যবহূত ড্রোনকে ‘গ’ শ্রেণী এবং রাষ্ট্রীয় বা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহূত ড্রোনকে ‘ঘ’ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, ‘ক’ শ্রেণীর ড্রোনের ওজন ১০০ গ্রামের কম ও ৫০০ গ্রামের বেশি হবে না। এছাড়া রিমোট পাইলট স্টেশনের ট্রান্সমিশন রেঞ্জ ২০০ মিটারের বেশি হতে পারবে না। ‘খ’ শ্রেণীর ড্রোনের ওজন সাত কিলোগ্রামের বেশি হবে না এবং রিমোট স্টেশনের স্পেসিফিকেশন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অনুযায়ী হবে। এছাড়া ‘গ’ ও ‘ঘ’ শ্রেণীর ড্রোনের ওজন, রিমোট স্টেশনের স্পেসিফিকেশনসহ অন্যান্য প্রতিটি বিষয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অনুযায়ী হবে।
খসড়া নীতিমালায় ড্রোন আমদানির ক্ষেত্রে ‘ক’ শ্রেণী ব্যতীত অন্য যেকোনো শ্রেণীর ড্রোনের ক্ষেত্রে আমদানির আগেই ড্রোনের বিস্তারিত স্পেসিফিকেশন এবং যে কাজে ও স্থানে ড্রোন ব্যবহার করা হবে, তা উল্লেখসহ প্রতিটি ড্রোনের জন্য ভিন্নভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। এ অনাপত্তি সনদ ইস্যুর ছয় মাসের মধ্যে ড্রোন আমদানি করতে হবে। ব্যবহার ও ওজনের ভিত্তিতে প্রতিটি ড্রোনের আমদানি শুল্ক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নির্ধারণ করবে। ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণীর ড্রোন আমদানির ১২০ দিনের মধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নির্ধারিত ফরমে ও পদ্ধতিতে আবেদন করে ড্রোনের নিবন্ধন নম্বর নিতে হবে।
‘ক’ শ্রেণী ব্যতীত প্রতিটি ড্রোনের জন্য বীমা করতে হবে এবং বীমার সমর্থনে কাগজপত্র বেবিচকে জমা দিতে হবে। আর বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ড্রোনের নিবন্ধনকারীর চুক্তির শর্তের কোনো প্রকার দুর্বলতা অথবা বীমার আর্থিক সীমা অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে কোনো দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতিপূরণের দায়মুক্তি থাকবে না। ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণীর ড্রোনের রিমোট পাইলট স্টেশন ও ড্রোনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী ফ্রিকোয়েন্সি অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা যেমন—রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, স্যাটেলাইট, এভিয়েশনের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী হওয়া যাবে না। এজন্য বিটিআরসি থেকে প্রত্যয়ন সংগ্রহ করতে হবে।
বেসামরিক এলাকায় সব শ্রেণীর ড্রোনের উড্ডয়নের জন্য বেবিচক থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তবে খোলা স্থানে যেকোনো শ্রেণীর ড্রোন উড্ডয়নের আগে অপারেটর ও রিমোট পাইলটকে ওই এলাকার ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ভিভিআইপি মুভমেন্ট আছে কিনা তা নিজ দায়িত্বে জেনে নিতে হবে। আর ভিভিআইপি মুভমেন্টের একদিন আগে ও মুভমেন্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত ড্রোন উড্ডয়ন বন্ধ থাকবে।
এ প্রসঙ্গে বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস) চৌধুরী এম জিয়াউল কবির জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছবি তোলা বা গবেষণার জন্য বেবিচক থেকে অনুমোদন নিয়ে ড্রোনের ব্যবহার হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া ড্রোন ওড়ালে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ কারণে ড্রোনের বিষয়টি শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার জন্য উড্ডয়ন ও আমদানি নীতিমালা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মনুষ্যবিহীন উড়োযানের যথেচ্ছ ব্যবহারে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে মনুষ্যবিহীন উড়োযান ও আনমেনড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) আমদানি, উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। ড্রোন উড্ডয়নে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি উল্লেখ করে ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ওই চিঠি দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (অপারেশনস) নাসিয়ান ওয়াজেদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ‘বিষয়টি অতীব জরুরি’ উল্লেখ করে বলা হয়, ড্রোন, মনুষ্যবিহীন উড়োযান ও ইউএভি আমদানি, উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বিভিন্নভাবে ড্রোনের ব্যবহার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে পারে। কারণ সম্প্রতি এসবের নানাবিধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। দূর নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন এসব আকাশযান বা ড্রোন নিঃশব্দে প্রায় ৪০০ ফুট বা ৪০ তলা ভবনের সমান উচ্চতায় উড্ডয়ন করতে পারে। এগুলো পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ক্যামেরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ড্রোনের সাহায্যে সার্ভেইল্যান্স, জরিপকাজ, ভিডিওচিত্র নির্মাণ, কৃষিক্ষেত্রসহ নানা গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব।
চিঠিতে আরো বলা হয়, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছবি সংগ্রহ করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য পাচারের আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নাশকতা চালানোর জন্য সারা বিশ্বে জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবিত কৌশল রপ্ত করার মাধ্যমে নাশকতা চালানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিনা অনুমতিতে দেশের আকাশে যেকোনো ধরনের মনুষ্যবিহীন যান ওড়ানো নিষিদ্ধ করে বেবিচক। যেসব স্থানে বিমানবন্দর নেই, সেখানে বেবিচকের ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ড্রোন ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া শিশুদের খেলনা উড়োজাহাজ আমদানি করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিরও নিয়ম রয়েছে।