শিবলী চৌধুরী কায়েস, নিউইয়র্ক : কখনো উত্তাল সাগর, কখনোবা গভীর অরণ্য ভেঙে স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানো অসংখ্য বাংলাদেশী মানবেতর জীবনযাপন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কারাগারে। জীবন বাঁচাতে সহায়তা চেয়ে টেক্সাসের এল পাসো’র কারাগার থেকে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক বরাবর চিঠি লিখেছেন বাংলাদেশী মাহবুব রহমান। গত ২১ মার্চ ওই চিঠিটি লেখা হয়, ডাকঘরে ছাড়া হয় ২৮ মার্চ।
মানবপাচার ইস্যুতে যখন বাংলাদেশ প্রতিদিনই খবরের শিরোনাম হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরো বিশ্বে যখন তোলপাড়; ঠিক তখনই টেক্সাসের ওই কারাগার থেকে লেখা চিঠি আলোচনার ঝড় তুলেছে দেশটির বাংলাদেশী কমিউনিটিতে।
খোঁজ নিয়ে ওই কারাগারে একাধিক বাংলাদেশী বন্দী থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনিসহ প্রায় ৯০ জন বাংলাদেশী টেক্সাসের এল পাসো’র এলাকার ওই কারাগারে আটক রয়েছেন। আদালত থেকে বন্দীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে আদেশ দেওয়া হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে জঙ্গিবাদসহ নানা ইস্যুতে নেতিবাচক প্রচারণা থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে মাসের পর মাস তারা কারাগারে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পাদক বরাবর লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এখানে আমাদের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। খুব অসহায় ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগুচ্ছি আমরা। আশা করি আপনারা সহযোগিতা করবেন।’
চিঠিতে বলা হয়, কেউ বর্ডার ক্রস করে দেশটিতে প্রবেশ করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের আইন মোতাবেকে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আসামিরা বন্ড পাওয়ার যোগ্য (১০ হাজার ডলার মুচলেকা) না হলে তাদের ইমিগ্রেশন এ্যান্ড কাস্টম এনফোর্সমেন্ট এ্যান্ড পোর্ট নোটিফিকেশন দেওয়ার (আইসিই) আদেশ দেওয়া হয়, যা এখানকার আইনে রাজনৈতিক আশ্রয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এদের ক্ষেত্রে দ্রুত বৈধতা পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশী বন্দীদের আইনী সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আমব্রেলাখ্যাত সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন। একই ভাবে বাংলাদেশী-আমেরিকান আইনজীবীদের কাছের টেক্সাসের ঘটনা তুলে ধরা হয়।
বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও কমিউনিটি নেতা আবদুর রহীম হাওলাদার দবলেন, ‘আসলে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর-নদী, বন কিংবা জঙ্গল পাড়ি দিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে আসা ঠিক না। এটি দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মানবপাচারের নির্মমতাও ছাড়িয়ে গেছে। তবে আজ আপনার দেওয়া এই চিঠি পেয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এতজন বাংলাদেশী বন্দী রয়েছেন। তাই বাংলাদেশ সোসাইটির আগামী ৩১ মের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।’
বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘দ্রুতই আমরা চেষ্টা করব বন্দীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তবে আমি ব্যথিত আমাদের সরকার কিংবা কনস্যুলেটের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো দৃষ্টি দেন না।’
ইমিগ্রেশন রাইটস নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশী আইনজীবী মোহাম্মদ এন মজুমদার বলেন, ‘টেক্সাসের কারাগারেই কেবল নয়, আমেরিকার সীমান্তবর্তী অসংখ্য কারাগারে বাংলাদেশীরা বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তার মধ্যে বেশিরভাগই টেক্সাসে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনে কেউ যদিও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেন তাহলে তার দায়িত্ব নেয় এ দেশের সরকার। এটাই এখানকার সংবিধানে স্বীকৃত ইমিগ্রেশন রাইটস। তবে তার আগে বর্ডার ক্রস করে প্রবেশকারীদের বিচারকের মুখোমুখি করা হয়। এর পর বিচারক তাকে বন্ড শর্ত এবং পেরোলের সুবিধা দেওয়ার আদেশ দেন।’
প্রশ্ন ছিল, ‘এরাও তো ভেতরে প্রবেশ করেই ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তাহলে তারা প্রাপ্য আইনী সুবিধা পাচ্ছেন না কেন’— জবাবে এ আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যা বলতেও খারাপ লাগছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ফায়দা লুফে নেওয়া কিছু মানুষের মিথ্যা প্রচারণায় আজকের এ অবস্থা।’
কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘একদিকে বাংলাদেশ সরকার বার বার বলছে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। অভিজিৎসহ বেশ কয়েকজন ব্লগারের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হেফাজতে ইসলামের উত্থান, আনসারুল্লাহ বাহিনী ইত্যাদি। বিএনপি-জামায়াত এদের মদদ দিচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। একই ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টেও কয়েকজন লিখিত আবেদনও করেছেন। এর ফলে বাংলাদেশী ওই বন্দীরা আশ্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ক্ষমতার মোহে হীন ব্যক্তিস্বার্থে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো বানানো হচ্ছে। বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জঙ্গিবাদের সঙ্গে তুলনা করে বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় (এ্যাসালম) প্রত্যাশী হাজার হাজার বাংলাদেশীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মিথ্য অপপ্রচার দেশবিরোধী, যা আগামী বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।’
এন মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র- এই অপপ্রচারের ফলে সব ধরনের রাজনৈতিক আবেদন পেন্ডিং রয়েছে। তা ছাড়াও সীমান্ত পাড়ি দেওয়ারা বন্দীজীবন পার করছেন। এ সবগুলোই এখন ঝুলে থাকবে। বিষয়টি সত্যিই আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য খারাপ সংবাদ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশকারী বাংলাদেশীদের মানবিক বিবেচনায় নয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত আছে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে দোটানায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। এর একমাত্র কারণ আমাদের দেশবিরোধী মিথ্যা প্রচারণা।’ টেক্সাসের এল পাসো’র কারাগারে বন্দী বাংলাদেশীদের বের করে আনতে বাংলাদেশী ও আমেরিকান এ্যাটর্নিদের নিয়ে কাজ করার আশ্বাস দেন এন মজুমদার।