পশুর নদীর চ্যানেলের খনন কাজ শেষ হওয়ায় বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া থেকে মংলা বন্দরের জেটি পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে ১৩১ কিলোমিটার নৌপথ। এতে দেশের সামুদ্রিক বন্দর মংলায় প্রাণ-চাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে।
এখন বন্দরে একসাথে ৩৩টি দেশি বিদেশি জাহাজ ভিড়তে পারছে। এ কারণে গেল অর্থবছরের তুলনায় এবার জাহাজে পণ্য আমদানির পরিমাণও বেড়েছে।
নেপাল, ভুটান ও ভারত এ বন্দর ব্যবহারের অপেক্ষায় রয়েছে।
বন্দরের সূত্রমতে, গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন সংলগ্ন করমজল, জয়মনিরগোল ও হারবারিয়া নামক স্থানে নোঙর করে পণ্য খালাস করত দেশি বিদেশি পণ্যবাহি বাণিজ্যেক জাহাজগুলো।
এদিকে বন্দরের প্রবেশ দ্বারে পলি জমায় বিগত দিনে বিদেশি পাইলটরা ঝুঁকির কারণে হারবারিয়া পর্যন্ত আসতে রাজি হত না বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রতি বছর পশুর চ্যানেলে পলি জমতো ১ দশমিক ৪ ফুট। পশুর নদীর নাব্য না থাকায় ৯ মিটার গভীরতায় জাহাজগুলো বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারত না।
এ কারণে ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে পশুর চ্যানেলে নাব্য সৃষ্টির জন্য ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে চায়না হারবার কোম্পানি ৩৫ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করে। এর পর চ্যানেলে পুনরায় নাব্য সংকট দেখা দিলে বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল একনেকের সভায় পশুর চ্যানেলে ড্রেজিং করার জন্য ১শ’ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়।
পরবর্তীতে এ ব্যয় বেড়ে যায়। ২০১২ সাল থেকে খনন প্রক্রিয়া শুরু হয়, শেষ হয় গত বছরের ২৩ নভেম্বর। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১শ’ ১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ৩৪ লাখ ৮ হাজার মিটার পলি অপসারণ হয়েছে।
বন্দর প্রকৌশল বিভাগের সূত্র জানায়, বন্দরের যাত্রা শুরুতে মংলা নালা ও পশুর নদীর সংযোগ স্থলে নদীর গভীরতা ছিল ৩৫ ফুট। এখন একসঙ্গে ৩৩টি জাহাজ ভিড়তে পারবে জেটিসহ ফেয়ারওয়ে বয়া।
এছাড়া ৪টি ট্রানজিট শীট ও ২টি ওয়ারহাউস রয়েছে। সেখানে ৬০ হাজার মেট্রিক টন মালামাল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটি কন্টিইনিয়ার ইয়ার্ড ও গাড়ি ইয়ার্ডে ২ হাজার গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, গেল অর্থবছরে এ বন্দরে ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ৩৬ লাখ ৮১ হাজার মেট্রিক টন মালামাল উঠানামা করে।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক পরিচালক কাজী গোলাম মুক্তাদের জানান, নেপাল ও ভুটানের নিজস্ব বন্দর না থাকায় কলকাতার হলদিয়া বন্দর ব্যবহার করে আসছে। এখন তাদের মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে।
বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী (নৌ) আলতাফ হোসেন খান জানান, গেল অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে ৩৪৬টি জাহাজ আসা যাওয়া করেছে। আর চলতি অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে ৩৪৫টি জাহাজ আসা যাওয়া করেছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ড্রেজিংয়ের পর থেকে বন্দরের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর আগে, মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভুটানের ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ২০১৩ সালের ১১ জুলাই বাংলাদেশ সফর করেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানান, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে খরচ কমানোর লক্ষে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ বন্দর সফর করে সুবিধাগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯৯৭ সালে নেপাল এ বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাতে সম্মতি দেয়।
১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৯৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেপাল ৬৩ হাজার তিনশ’ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করে এ বন্দরের মাধ্যমে। ট্রাকযোগে বাংলাবন্দ চেকপোস্ট হয়ে সে দেশে নেওয়া হয়। প্রতিবেশী দেশের বাধার পর এ প্রক্রিয়ায় মালামাল আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৯ সালে নেপালের পক্ষ থেকে মংলা বন্দর ব্যবহারের আবারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নেপাল এগিয়ে না আসায় এ উদ্যোগ সফল হয়নি।
১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর দি সিটি অফ লিয়ন্স নামক ভিনদেশী জাহাজ পশুর নদীতে নোঙর করার মধ্য দিয়ে চালনা এংকরেজের যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে নামকরণ করা হয় মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।