এভিয়েশন নিউজ: বাংলাদেশের প্রায় দুই লাখ নারী-পুরুষ শ্রমিক লেবাননে দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে কাজ করছে। সেখানে দালালদের হাতে জিম্মি শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা। অভিযোগ আছে, দালালদের নির্যাতনে শ্রমিকদের মৃত্যুকে চালানো হত স্বাভাবিক মৃত্যু বলে। ২০১২ সালে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর শ্রমিকরা ভেবেছিল তারা তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারবে। উল্টো দূতাবাসের বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। জানা গেছে, বছর খানেক আগে নির্যাতনে এক নারী শ্রমিক মারা গেলে তার ছয় হাজার ডলার দূতাবাসের এক কর্মকর্তা মেরে দেন। বাংলাদেশি দালাল চক্রের সঙ্গে দূতাবাসের ওই কর্মকর্তার সম্পর্ক আছে। যার কারণে শ্রমিকরা তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা গিয়ে রাষ্ট্রদূতের কাছে বলতে পারেন না।
শরিয়তপুরের ইয়াসমিন (৩০) জানান, দুই বছর আগে তিনি ফকিরাপুল এলাকার একটি অফিসের মাধ্যমে লেবাননে আসেন। তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়া হয়। লেবাননে আসার পর বাংলাদেশি দালাল তাকে এক লেবানীজের অফিসে নিয়ে যায়। তারা তাকে কোন কাজ না দিয়ে মারধর করে অফিস থেকে বের করে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন দালালের খপ্পরে পড়েছেন। পরে ইয়াসমিন নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বাসায় কাজ নেন।
জানাগেছে, ইয়াসমিনের মত আরো অনেক নারী প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে যারা পড়ালেখা জানেনা তারা। কেউ দেহ ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছের। কেউ কেউ কোন পুরুষ লোকের হাত ধরে টিকে আছে।
এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাটি গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেন। ঐ কর্মকর্তা দালাল চক্রের সঙ্গে জড়িত। দালাল চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে যে সকল নারী শ্রমিক সেখানে গিয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই পরিণতি হয়েছে একই। দালালরা ২শ ডলার মাসিক বেতনে কাজের কথা বলে একশ ডলার দেয়। অথচ কফিলের কাছ থেকে ঠিকই ২শ ডলার আদায় করে। শ্রমিকদের দেয় ১শ ডলার। প্রতিবাদ করলে দালালের অফিসে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে। অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ইতিমধ্যে মনিরা নামে এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে।
ইত্তেফাকের প্রতিনিধির সঙ্গে অনেক নারী-পুরুষ তাদের উপর নির্যাতন, দুর্বিষহ অবস্থার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী লেবাননে শান্তি রক্ষা মিশনে আসার পর তাদের দুর্বিষহ অবস্থা নিরসন ঘটতে শুরু করে। কিন্তু দালালদের নির্যাতন কমেনি। দালাল চক্রের হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জানা গেছে, অনেকে বাসা বাড়িতে কাজ করতে যান কিন্তু লেবাননের ভাষা না জানালেবানীজ ভাষা জানে না। তাদের ভাষা না বুঝতে পেরে মারধরের শিকার হয়। অনেকে এসব নির্যাতন সহ্য করে পরে আস্তে আস্তে ভাষা শিখে ফেলে। তখন মারধর ও নির্যাতন করেনা। লেবানীজকে ঠিকমত বেতন-ভাতা দিয়ে দেন। আবার অনেকে ভাষা শিখে নেন। তারা বাংলাদেশ অনেক গুণ ভাল রয়েছে। থাকছে বিলাশ বহুল অবস্থার মধ্যে। বাংলাদেশী দালালরা বেশী নির্যাতন করে সেখানে। সম্প্রতি নাসিমা বেগম নামে এক তরুনী লেবানীজদের এক বাসায় মারা যায়। তার মৃত্যুর পর দূতাবাস দেনদরবার করে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৮ হাজার ডলার এক কর্মকর্তা গ্রহণ করে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের ঐ কর্মকর্তা নানা অজুহাত ও তালবাহানা করার কারণে নাসিমার লাশ ছয় মাস সেখানে থাকে। বর্তমান রাষ্ট্রদূত যোগদান করার পর বিষয়টি তার নজরে আসে। দ্রুত নাসিমার লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। নাসিমার লাশ বাংলাদেশে পাঠাতে মাত্র দুই হাজার ব্যয় হয়। বাকি ৬ হাজার ডলার দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঐ ডলার তিনি আর নাসিমার স্বজনদের কাছে দূতাবাসের কর্মকর্তা পাঠিয়ে দেননি। বাবুল নামে এক পেশাদার সন্ত্রাসী লেবাননে দালাল চক্রের নেতা।
তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। লেবাননে একাধিক বিয়ে করে নির্যাতন করেছে। বাংলাদেশে নারীদের লাখ লাখ টাকা বাবুল হাতিয়ে নেয় বলে মহিলা শ্রমিকরা অভিযোগ করেন। বাংলাদেশী তরুণীদেরকে সে রাতে তার অফিস কিংবা বাসা নিয়ে পাশ ঠিক নির্যাতন চালায়। তার সঙ্গে দূতাবাসের ঐ কর্মকর্তার ভাগাভাগি সম্পর্ক রয়েছে। লেবাননে দুই লাখ শ্রমিক রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩০ ভাগ নারী দালালদের খপ্পরে পাশবিক নির্যাতনের শিকার। নির্যাতিত ইয়াছমিনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই অভিযোগ করেন, পারভীন, পারুল, তাসলিমা, রাবেয়া, মরিয়ম, নজরুল ইসলাম, নাজমুল হক। তারা বলেন, সরাসরি লেবানন সরকার বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানো হলে নিরাপদে কাজ করা সম্ভব। ৭০ ভাগ শ্রমিক যারা … মাধ্যমে সরাসরি লেবাননে এসে নিরাপদ পরিবার-পরিজন সুখ-শান্তি বসবাস করছেন। চাকরি করে যাচ্ছে নিরাপদে।
শান্তি মিশনে লেবানীজরা নৌবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ শ্রমিকদের উপর। তারা বিনামূল্যে বাংলাদেশ শ্রমিক আনতে রাজী। বাংলাদেশ থেকে লেবানীজ ভাষা শিখে আসলে শ্রমিকরা অনেক ভাল করবে। নৌবাহিনীর কল্যাণেও তাদের প্রচেষ্টায় ২০১২ লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস চালু করা হয়। এরপর থেকে সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অনেক সমস্যা সমাধান নিরসন হতে থাকে। কিন্তু ঐ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কারণে অনেক অভিযোগ ও সমস্যার কথা রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রদূতের কাছে পৌঁছালে সেই সমস্যা দ্রুত নিরসন হয়ে যায়। এমন অভিযোগ মহিলা শ্রমিকরা করেছেন। দূতাবাস চালুর আগে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ শ্রমিকদের সমস্যা ও অভিযোগ দূতাবাসের ন্যয় কফিলদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিরসন করা হতো। নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা দূতাবাসের দায়িত্ব পালন করেছেন।
লেবাননে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভূমধ্যসাগরে নিরাপত্তায় দুঃসাহসিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সততার প্রশংসা লেবানীজবাসির দুখে দুখে। নৌবাহিনীর ভূমিকা লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাস চালু করা সম্ভব হয়। লেবানন সরকার ও বাংলাদেশে দূতাবাস খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। লেবাননে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এএফএম গাউসুল আজম সরকার বলেন, তিনি যোগদান করার পর লেবানন শ্রম মন্ত্রণালয়, কফিলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। বাংলাদেশী শ্রমিকদের সমস্যা নিরসনের কার্যক্রম শুরু করেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ নিয়ে তিনি সরাসরি কথা বলেন এবং লেবানন সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা দিয়ে আসছে। দালাল কর্তৃক সমস্যা হচ্ছে। তা নিরসন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখানে শ্রমিকদের অভিযোগ, করণীয় বিষয় সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে পাঠিয়েছেন। গতকাল বৃস্পতিবার সন্ধ্যার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঐ লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের অভিযোগ সম্পর্কে কিছু জানেন না।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। দালালদের খপ্পর থেকে শ্রমিকদের বেসুর পাওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। লেবাননের বিষয় তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা দরকার তা করাই হবে বলে তিনি জানান।