মাঈনুল ইসলাম নাসিম, ব্রাজিল থেকে: গত ২৮ জুন, শনিবার রাতে ব্রাজিলের শিল্পনগরী পারানায় খুন হয় জাহেদ আহমেদ (২৮) নামে এক বাংলাদেশি যুবক। সে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুরিকান্দি গ্রামের ছেলে। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, গলাটিপে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করার হয়েছে। ঘটনার রাতে কোন এক সময় শহরের স্থানীয় একটি আবাসিক হোটেল কক্ষে হত্যা করা হয় জাহেদকে। তার মৃতদেহ রাতের অন্ধকারেই হোটেল থেকে বের করে ফেলে রাখা হয় সিয়ানর্চে এলাকার পুলিশ স্টেশন লাগোয়া পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে। পরদিন খবর পেয়ে পুলিশ জাহেদের লাশ উদ্ধার করে।
জাহেদের পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ইতোমধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হলেও অজ্ঞাত থেকে যায় হত্যাকাণ্ডের রহস্য। বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলো থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরবর্তী পারানাতে এক পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন জাহেদ। সেখানকার একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে বৃহস্পতিবার নিশ্চিত করেছে, প্রেমের সূত্র ধরেই ঘটেছে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। নারীঘটিত আলামত পাওয়ার বিষয় উল্লেখ করে এরই মাঝে স্থানীয় টেলিভিশনগুলো ফলাও করে সংবাদও প্রচার করেছে।
গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা উইলসন হেনরিক্স বলেন, পরিত্যক্ত স্থানটি থেকে বিবস্ত্র অবস্থায় নিহত জাহিদের লাশ উদ্ধার করেন তারা। লাশের মুখমন্ডলসহ শরীরে কয়েকটি স্থানে লালচে দাগ ছাড়া অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শ্বাসরোধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে পারানা পুলিশ। পরিত্যক্ত স্থানটি থেকে বড় একটি খালি ব্যাগও উদ্ধার করা হয়। ব্রাজিলের আইন অনুযায়ি নিকট আত্মীয় ব্যতীত অন্য কারো কাছে মরদেহ হস্তান্তরের বিধান না থাকায় পারানার লন্দ্রিনা এলাকায় জানাজা পরবর্তী দাফন সম্পন্ন হয় জাহেদের।
প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করতে এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে জোর তদন্ত চালাচ্ছে পারানা পুলিশ। তবে স্থানীয় অধিবাসীদের কয়েকজন জানান, সময়ের ব্যবধানে চাপা পড়ে যাবে দুঃখজনক এই হত্যাকাণ্ড। প্যারাগুয়ের সীমান্তবর্তী অপরাধপ্রবণ এই অঞ্চলটিতে হরহামেশা খুনখারাবি লেগেই থাকে। কিছুদিন আগে এই পারানাতেই মারিঙ্গা এলাকায় খুন হন আরেক বাংলাদেশি। আগেকার ঐ হত্যাকাণ্ডের সাথে জাহেদ খুন হওয়ার কোন যোগসূত্র আছে কিনা- তাও খতিয়ে দেখছে পারানার গোয়েন্দা বিভাগ।
এদিকে শনিবার রাতে জাহেদ খুন হওয়ার দু’দিনের মাথায় ৩০ জুন পারানাতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অপর এক বাংলাদেশি। সোহলে আহমেদ নামে ওই বাংলাদেশি এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। সে সিলেটের গোলাপগঞ্জের বাসিন্দা।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, সোমবার রাত ন’টার দিকে রোলান্দিয়া এলাকার সান ফেরনান্দোতে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সোহেলক উদ্ধার করেন ফায়ার সাভির্সের একটি দল। রোলান্দিয়া পারানার অন্তর্ভুক্ত লন্দ্রিনা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরের একটি এলাকা। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় সোহেলকে সান রাফায়েল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক।
জাহেদ খুন হওয়ার পর ঢাকার জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর বরাত দিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে বলা হয়, জীবিকার সন্ধানের পাশাপাশি এক বান্ধবীর ডাকে ব্রাজিল যান জাহেদ। এদিকে ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বান্ধবীর ডাকে বা আমন্ত্রণে মৌলভীবাজার থেকে পারানা গমন করার বিষয়টি সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। ১০ লাখ টাকা খরচ করে জাহেদের ব্রাজিল আসার বিষয়টি সত্য হলেও আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অপরাপর বাংলাদেশিদের অনেক অজানা তথ্য।
জীবিকার সন্ধানে জাহেদের মতো আরো হাজার চারেক বাংলাদেশি এখন ব্রাজিলে অবস্থান করছে। তাদের প্রায় সবাইকেই ৮-১০ লাখ টাকা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ১২-১৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে ব্রাজিল আসার জন্য। জানা যায়, দালালদের খপ্পরে পড়ে দেশ থেকে দেশে সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ব্রাজিলে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অর্ধেকের বেশিই নবাগত। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, পতিতাবৃত্তি যেদেশে শতভাগ বৈধ এমন এক ভূখন্ডে, তথা আজকের দুনিয়ার সবচাইতে ‘সেক্স ফ্রি কান্ট্রি’ ব্রাজিলের মাটিতে পা দেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই নবাগত বাংলাদেশিদের একটা বিশাল অংশই আত্মহারা হয়ে পড়েন অবাধ যৌনতায়।
ব্রাজিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকের কাছেই সেক্স এখন বিয়ারের চাইতেও সহজলভ্য। পারানা, পোর্তো আলেগ্রো, সাও পাওলো সহ ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত বাঙালিরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন অবাধ যৌনতায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নবাগত বাংলাদেশিদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭-৮ জনই এখন ঐ পথে হাঁটছেন সাম্বা নৃত্যের দেশে।
বহু ঘটন-অঘটনের মাঝে পোর্তো আলেগ্রের একটি ঘটনা এখন বাংলাদেশিদেরই মুখে মুখে। মেস করে একই বাসায় থাকেন এমন বাংলাদেশি ব্যাচেলরদের একটি গ্রুপ রাস্তা থেকে একজনকে চুক্তি করে বাসায় নিয়ে আসার পর বুঝতে পারে ঐ সুন্দরী আসলে হিজড়া সম্প্রদায়ের। দেশটিতে বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ার সুবাদে একদিকে যেমন দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যৌনতার সাগরে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, পাশাপাশি সময়ে সময়ে ঘটে যাওয়া সব কিছুই কমিউনিটিতে প্রকাশও হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোন রকম বাছ বিচার ছাড়াই ফ্রি সেক্সে মিশে গিয়ে দেশটির বাংলাদেশিরা আজ জড়িয়ে পড়ছে রকমারি সব সেক্স ক্রাইমে। এর সাথে ধীরে ধীরে যোগ হতে শুরু করেছে মাদক সংক্রান্ত আরো ভয়াবহ বিষয়াদি। নৈতিকতায় ধ্বস নামা বাংলাদেশি একটি বড় জনগোষ্ঠির উল্লেখযোগ্য অংশ আবার বিভিন্ন শহরে ইদানিং লিপ্ত হচ্ছে প্রেমিকা নিয়ে কামড়াকামড়িতে। একই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশিদের টানাহ্যাঁচড়াটি অবশ্য ঘটছে ভিনদেশি যুবকদের সাথে। ইউরোপিয়ানদের তুলনায় অনেক সহজ সরল মনের সাদাসিধে ব্রাজিলিয়ান মেয়েরা কখনো কখনো ভিনদেশী যুবকদের প্রতারণারও শিকার হচ্ছে।
প্রেমিকার ওপর কর্তৃত্ব জাহির করার দৌড়ে একে অপরকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে শাসানো ব্রাজিলে এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশিরা জড়িত ছিলেন বিগত দিনে এমন বেশ কিছু অঘটন ঘটতে গিয়ে অল্পের জন্য রক্ষা হলেও পারানায় এ যাত্রায় সেই সেক্স ক্রাইমেরই বলি হয়ে গেলেন জাহেদ আহমেদ। সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে আসা সদা হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল যুবক জাহেদের পরিণতি যাতে আর কারো না হয় বিদেশ বিভুঁইয়ে, এমন আশাবাদ জাহেদের কর্মস্থলের লোকজনেরই।