চরম আর্থিক সংকট কালেও অপরিকল্পিতভাবে বিভাগওয়ারী গণ সয়টওয়ার ক্রয় করে ৭০ কোটি টাকার বেশি শ্রাদ্ধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিমান। এয়ারলাইন্স বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব সফটওয়ার ক্রয়ে সংশ্লিষ্টদের কমিশন বাণিজ্য ছাড়া বিমানের আভ্যন্তরিক ও দাফতরিক কোন লাভ হবে না। উপরোন্ত বাড়বে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। খোদ বিভাগগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারাও পৃথক পৃথক সফটওয়ার ক্রয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বিমান পরিচালণা পর্যদের বেশিরভাগ সদস্যই এনিয়ে ক্ষিপ্ত। তারা বলছেন, এভাবে আলাদা আলাদা সফটওয়ার ক্রয় না করে বিমানের জন্য এই মুহুর্তে প্রয়োজন একটি সমন্বিত (ইন্টিগ্রেটেড) সফটওয়ার। যেটি দিয়ে একনজরে পুরো বিমানকে দেখা যাবে। এক ক্লিকে জানাা যাবে বিমানের লাভ-ক্ষতি, কমার্শিয়াল প্ল্যানিং, ফ্লাইট সিডিউল, টিকিট বিক্রি, যাত্রী সংখ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও রক্ষনা-বেক্ষন, লজেস্টিক এন্ড ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট, ফ্লাইট ডাটা মনিটরিং ও এনালাইসিস, সেফটি ও কোয়লিটি ম্যানেজমেন্ট, মেরামত, ক্রয়-বিক্রয়, কার্গো ব্যবস্থা, বিএফসিসি, ক্রু সিডিউল, ফুয়েল কনজামশন এনালাইসিস ম্যানেজমেন্ট, এমআরও, সেন্ট্রাল কন্ট্রোল, রুটস এন্ড ফুয়েল, ট্রেনিং, যানবাহন সমন্বয়, ইন্টিগ্রেটেড ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও বিমানের কর্মকতা-কর্মচারীদের দৈনন্দিন কার্যক্রম। ঘরে বসে জানা যাবে বিশ্বের ১৯টি স্টেশনের প্রতি ঘন্টার কার্যক্রম, আর্থিক অবস্থা ও ফ্লাইট পরিস্থিতি। কিন্তু তা না করে বিমান ম্যানেজমেন্ট প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা কোম্পানীর কাছ থেকে আলাদা সফটওয়ার ক্রয় করতে যাচ্ছে। যা দিয়ে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যক্রম জানা যাবে।
ইতোমধ্যে ৮টি বিভাগের পক্ষ থেকে সফটওয়ার ক্রয়ের জন্য আন্তজাতিক দরপত্র আহবান করা হয়েছে। যেগুলো ক্রয় করতে এই মুহুর্তে বিমানের খরচ হবে ৬০ কোটি টাকা থেকে ৭০ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে বিমানের সাবেক এমডি ও পরিচালক কাস্টমার সার্ভিস মোসাদ্দেক আহম্মেদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই গণসফটওয়ার ক্রয়ের নেপথ্যে কাজ করছে। তাদের সহযোগিতা করছে পরিকল্পনা বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বেলায়েত হোসেন, কন্ট্রোলার অব একাউন্টস ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ফাইনান্স) মঞ্জুর ইমাম, মার্কেটিং বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল হাসান। এছাড়া ফ্লাইট অপারেশন, বিক্রয় ও সম্ভার, রুটস এন্ড ফুয়েলিং, ফাইনান্স, কার্গো ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কতিপয় দুনীতিবাজ কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে কাজ করছে। আর মোসাদ্দেক আহম্মেদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রনালয়কে ম্যানেজ করার। মোসাদ্দেক আহম্মেদের সঙ্গে মন্ত্রনালয়ের ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় খোদ বিমান এমডি পর্যন্ত তাকে সমিহ করে চলেন। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুদক থেকে আড়াই কোটি টাকার দুনীতির অভিযোগ আনা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভৎসানার পরও বিমান এমডি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি।
বিমানের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অবস্থাদৃস্টে মনে হচ্ছে দুনীতিবাজরা এমডিকে তাবিজ-কবজ করে ম্যানেজ করে রেখেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ারলাইন্স ব্যবস্থাপনায় ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ বিদেশী এমডি কিভাবে গণহারে পৃথক কোম্পানীর কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সফটওয়ার ক্রয় করতে যাচ্ছে এটা রহস্যজনক। বর্তমানে বিশ্বের কোন এয়ারলাইন্সে এধরনের গণ সফটওয়ার ব্যবহারের নজির নেই। সবাই এখন একক কোম্পানীর ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) সফটওয়ার ব্যবহার করছে। কিন্তু বিমান যাচ্ছে উল্টো পথে। মুলত এককালিন বিমানের বিপুল অংকের টাকার শ্রাদ্ধ এবং ভবিষ্যতে কমিশন বানিজ্য অন্যতম উদ্দেশ্য। তাদের মতে সমন্বিত সফটওয়ার ক্রয় করলে বর্তমানে যে টাকা খরচ পড়বে তার অর্ধেক টাকা সাশ্রয় হবে। বিশেষজ্ঞরা অবিলম্বে গণ হারে বিভিন্ন কোম্পানীর সফটওয়ার ক্রয় না করে বিমানের প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি সমন্বিত (ইন্টিগ্রেটেড) সফটওয়ার ক্রয়ের পরামর্শ দিয়েছেন।
জানাগেছে, গণসফটওয়ারে এক কোম্পানী আরেক কোম্পানীতে প্রবেশাধিকার থাকবে না। প্রবেশ করতে গেলেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে। সফটওয়ার আপডেগ্রেড করতে টাকা লাগবে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের সফটওয়ার হলে সব ধরনের সার্ভিসের ক্ষেত্রে বিমানকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা সিইও‘র পক্ষেও তার কক্ষে বসে এক নজরে পুরো বিমানকে দেখা সম্ভব হবে না।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপক্ষে করে গত এক মাসে বিমানের রেভিনিউ, সেল্স এন্ড মার্কেটিং, ফাইনান্স, অপারেশন, কার্গো, জ্বালানী তেল, ক্রু সিডিউল বিভাগ থেকে ৮/১০টি সফটওয়ার ক্রয়ের জন্য আন্তজাতিক দরপত্র আহবান করা হয়েছে। কয়েকটি বিভাগের দরপত্র ইতোমধ্যে যাচাই বাছাই হয়ে গেছে। জানাগেছে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৬/৭টি কোম্পানীকে এসব সফটওয়ার সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে বিমান পরিচালণা পর্যদের কোন অনুমোদন না নিয়ে বিমান এমডির একক অনুমোদনে কার্যদেশ দেয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে বিমানের একজন বোর্ড সদস্য অভিযোগ করেন।
জানাগেছে ৮ বছর আগে বিমানের অপারেশন বিভাগের জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি সফটওয়ার ক্রয় করা হলেও এখন পর্যন্ত সেটি ব্যবহার করা হয়নি। এখন আবার সেই অপারেশন বিভাগর জন্য ক্রু সিডিউলিংয়ের নামে আলাদা সফটওয়ার ক্রয় করা হচ্ছে। অপর দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ৪/৫ বছর আগে তাদের বিভাগের জন্য আলাদা একটি সফটওয়ার ক্রয় করেছিল। কিন্তু গত তিন মাস আগে ওই সফটওয়ারটি ব্যবহার শুরু করেছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। কিন্তু শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, এই সফটওওয়ার দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কার্যক্রম ছাড়া অন্য কোন বিভাগের তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে না। তার মতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সঙ্গে ইনভেন্টরী ম্যানেজমেন্ট, ক্রয় ও সম্ভার, সেল্স, ফাইনান্সসহ সব বিভাগের কাজের সমন্বয় থাকা দরকার। যা এই সফটওয়ার দিয়ে কোনভাবেই সমন্বয় করা সম্ভব নয়। এতে পুরো টাকায় গচ্চা গেছে।
এদিকে টিকেট রিজার্ভেশনের ক্ষেত্রে সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে ৫টি বিদেশী কোম্পানীর সফটওয়ার (এ্যামাডিউস, গ্যালিলিও, গ্যাব্রিয়েল, স্যেইবর ও অ্যাবাকাস) ব্যবহার করা হলেও বিমান মানেজমেন্ট ৫ বছর ধরে অহেতুক সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন এজেন্সি (সিটা) নামক একটি বিদেশী কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি করে বছরে শত শত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করে চলছে। সম্প্রতি কোন ধরনের আন্তর্জাতিক টেন্ডার ছাড়া আবারো সিটার সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করা হয়েছে। জানাগেছে এই চুক্তির নেপথ্যে বিমানের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের সঙ্গে বড় অংকের টাকা আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে।
গত অর্থ বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন সিস্টেম (সিআরএস) প্রোভাইডারকে ১৪০ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। সরকারি অডিটে এ ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করা হয়। অডিট রিপোর্টে বলা হয় ওই অর্থবছরে বিমান মোট ১৬ লাখ ২১ হাজার যাত্রী বহন করে। গ্লে¬াবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের আওতায় যদি এসব যাত্রী টিকেট কিনে থাকেন তাহলে সংশ্লিষ্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের বিল হওয়ার কথা ছিল ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কিন্তু বিমানকে ১৪০ কোটি টাকা বিল দিতে হয়েছে। এই বিপুল অংকের টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়েছে বিমানের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট ও সিটার স্থানীয় এজেন্টের মধ্যে।
এব্যাপরে জানতে বিমানের এমডি ও সিইিও কেভিন জন স্টিলকে শনিবার দুপুরে মেইল করা হলেও তিনি কোন জবাব দেননি। বিমান বোর্ডের সাবেক সদস্য ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে জানান, বিমান এখন চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। কাজেই এখন সমন্বিত সফটওয়ার ক্রয়ই বিমানের জন্য সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত। এতে টাকার সাশ্রয় হবে। মুলত খাত ওয়ারি কমিশন বাণিজ্য করার জন্য বিমানের দুনীতিবাজরাই এভাবে গণ সফটওয়ার ক্রয় করতে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।