মাঈনুল ইসলাম নাসিম, এভিয়েশন নিউজ: ‘‘ঘোড়ায় চড়িয়া ….. হাঁটিয়া চলিল’’। জীবনের পথে অবিরাম হেঁটে চলা এক সংগ্রামী যুবক মেহেদি হাসান। বঙ্গোপসাগরের কোলে পটুয়াখালিতে তাঁর জন্ম। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পদভারে মুখরিত হলেও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় পড়াশোনা শেষ না করেই গুডবাই জানাতে হয় বাংলাদেশকে। সাধনা ও অধ্যবসায়ের গুনে পটুয়াখালি থেকে ১৬ হাজার ৭শ’ কিলোমিটার দূরে বুয়েনস আয়ার্সের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি আজ আর্জেন্টাইন নাগরিক এই মেহেদি হাসান। ডুয়েল সিটিজেনশিপের সুবাদে আর্জেন্টাইন বাংলাদেশি তিনি।
পটুয়াখালির পুরাতন বাজারের সুলতান আলম গাজী ও আলেয়া বেগমের সন্তান মেহেদি। নব্বইর দশকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় তাঁকে। ইচ্ছে ছিল টোয়েফল দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সাধ আছে সাধ্য নেই এমন কন্ডিশন, কে দেবে অর্থের যোগান। ২ ছেলে ২ মেয়ের সংসারের হাল ধরা বাবা সুলতান আলম গাজীর ঔষধের ব্যবসায় বড় ধরনের লস হয়ে গেলে ঐ সময় থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় মেহেদিকে। জীবন নামের রেলগাড়িতে জ্বালানি ভরতে শুরু করেন টিউশনি।
ঢাকা কলেজের মতো নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মায়া ত্যাগ করতে হলেও পড়াশোনা যে তাঁকে করতেই হবে। প্রাইভেটে ডিগ্রীও পাশ করলেন। পড়াশোনা ও টিউশনির পাশাপাশি নিয়ে নিলেন কম্পিউটার ট্রেনিং। বাহরাইনে একটি আইটি জবের অফার পেয়ে উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু কপালের লিখন যায় না খন্ডন। টিউশনি থেকে সঞ্চয় করা ২ লাখ টাকাই জলে গেলো দালাল কর্তৃক প্রতারিত হয়ে। কিন্তু তাতে কি ! থমকে যাবার পাত্র নন অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী মেহেদি হাসান।
ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত টমি মিয়া ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে গেলেন তিনি, ডিপ্লোমা করবেন হোটেল ম্যানেজমেন্টে। একই সাথে জিওগ্রাফিতে মাস্টার্সে ভর্তি হবারও সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাতে টমি মিয়া ইনস্টিটিউটে হোটেল ম্যানেজমেন্ট আর দিনে ইউনিভার্সিটিতে জিওগ্রাফির ক্লাস দুটোই চললো। মেসে থেকে-খেয়ে মেহেদির টিউশনি চলছিল সেই শুরু থেকেই, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই চালিয়ে যাওয়া। এক বছরে ৪৫ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করলেন টমি মিয়া ইনস্টিটিউটকে, যার পুরোটাই যথরীতি টিউশনি থেকে।
টমি মিয়া ইনস্টিটিউটের সেকেন্ড ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ৫২ জনের মধ্যে চতুর্থ স্থান অর্জনের কৃতিত্ব দেখালেন মেধাবী মেহেদি, কিন্তু কথা রাখলেন না বিখ্যাত টমি মিয়া। ভর্তি হবার সময় কথা ছিল যারা ভালো করবে তাদেরকে বিলেতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে উচ্চ বেতনে চাকরি নিশ্চিত করা হবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, হোটেল ম্যানেজমেন্ট সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে অন্য সবার মতো মেহেদিকেও বলা হলো, যারা ইউকে থেকে স্পন্সর যোগাড় করতে পারবে অর্থাৎ বিলেতে যাদের মামা-খালু আছে শুধুমাত্র তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে ভাগ্যদেবী। বিলেতে মামা-খালু না থাকার শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করে মেহেদি।
পটুয়াখালির যুবকটিকে বহনকারী জীবন নামের রেলগাড়ি বারবার লাইনচ্যুত হতে থাকে এভাবেই। লোভী স্লিপারের ওপর অসমান্তরাল রেললাইনে বহে চলা প্রতারক নাইট ট্রেনের যাত্রী মেহেদিকে ঘিরে ধরে হতাশা অস্থিরতা অনিশ্চয়তা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে একদিন মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন কয়েক ঘন্টা। একবার না পারিলে দেখো শতবার …. শৈশবে বাবা-মা স্কুল শিক্ষকদের কাছে শোনা কঠিন বাস্তবতার স্মৃতিচারণ দারুণ নাড়া দেয় তাকে। না, আর মাথায় হাত নয়, উঠে দাড়ালেন।
পেছন ফিরে তাকাবার যুবক নন মেহেদি হাসান। যানযটের নগরী ঢাকাতে এবার চাকরি খোঁজার পালা। শুরুতে ভাবতে পারেনেনি যে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। জুতো-সেন্ডেল সব কিছুর তলা ক্ষয় করলেন, কিন্তু সেই টমি মিয়ার ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফিকেট ধুয়ে পানি খাওয়ার মতো মামা-খালু ছাড়া চাকরির বাজারে ঢাকা শহরেও বাতি নিভু নিভু। একটি জব মেহেদির খুবই প্রয়োজন তবে যে কোন অংকের ঘুষ দিতে সদা অপ্রস্তুত ছিলেন তিনি।
মাস্টার্সের ক্লাস চলছে তাঁর, কিন্তু যখন দেখলেন মাস্টার্স পাশ করেও অনেকের পরিণতি ঠিক তাঁরই মতো, তখন সিদ্ধান্ত সঞ্চয় বাড়াবার, দেশ ছাড়ার। ইতিমধ্যে কম্পিউটারের একজন ভালো ‘চিকিৎসক’ হিসেবে মেহেদি নিজেকে কিছুটা হলেও পরিচিত করে তুলেছেন ঢাকায়। ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস আক্রান্ত পিসিকে রোগজীবানুমুক্ত করার কাজে ভালো দক্ষতা অর্জন করেন সময়ের ব্যবধানে। পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন অফিসে ও বাসায় গিয়ে গিয়ে কাজ করার সুবাদে মোটামুটি ভালো আয় হতে লাগলো তাঁর।
টিউশনি আর পিসি মেরামত থেকে ৫ লাখ টাকা ক্যাশ করার পথে ৫ টি টাকাও অপচয় করেননি মেহেদি। ঢাকা শহরের অনেক লাল-নীল বাতি অনেকের মতো মেহেদিকেও আলোকিত করতে চেয়েছিলো, কিন্তু আবারো সেই একই কথা ‘‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট….।’’ শুধু অটুটই নয়, পারিবারিক মূল্যবোধে উজ্জ্বীবিত থেকে আত্মবিশ্বাসে অবিচল মেহেদির এবার দেশান্তরি হবার পালা। এরই মধ্যে ঢাকায় যুব পর্যটক ক্লাবের সাথে তাঁর যোগাযোগ। বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণকারী আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে ডেস্টিনেশান নির্ধারিত হয়ে গেলো মাহাথির মোহাম্মদের দেশ।
২০০৭ সালের কথা, বছরটিকে ‘ট্যুরিজম ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল মালয়েশিয়ান সরকার। ঢাকা-কুয়ালালামপুর-ঢাকা রিটার্ন টিকিট থাকলেই ভিসা পাওয়া যেতো ঐ সময়টায়। মূলতঃ উজ্জলের উদ্যোগের ফলেই ট্যুরিস্ট ভিসায় ৫ বন্ধু একসাথে রওয়ানা হলেন মালয়েশিয়ায়। লাতিন আমেরিকার প্রতি আগে থেকেই জেনেশুনে দুর্বল ছিলো মেহেদি। বিশাল ভূখন্ড, জনসংখ্যা কম, অপার সম্ভাবনা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দূতাবাস ঢাকায় না থাকায় সহজে ভিসা প্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রেখেই মূলতঃ তাঁর কুয়ালালামপুর গমন। যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। মালয়েশিয়ার রাজধানীতে আর্জেন্টাইন দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে ৫ জনের মাঝে ৪ জনই এক মাসের মাথায় কুয়ালালামপুর থেকে উড়ে চলে এলেন সুদূর বুয়েনস আয়ার্সে।
নতুন দেশ আর্জেন্টিনা, নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ৪ বন্ধু। জীবনের বহুমুখী হিসেব নিকেষে বাকি সব বন্ধুরা বছর না পেরুতেই বাংলাদেশে ফিরে গেলেও থেকে গেলেন সাহসী যুবক মেহেদি। রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে তখন মাত্র ৪০-৪৫ জন বাংলাদেশির বসবাস। স্বদেশীদের সাথে মেসে বসবাস। তবে ঢাকায় যেমন বসে থাকেননি, এখানেও সূর্যোদয়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছেন টার্গেট ফুলফিল করতে। ‘হোম এন্ড এব্রড’ জীবন সংগ্রামে শুরু হলো তাঁর নতুন এপিসোড।
বুয়েনস আয়ার্সের ডাউন টাউনে কাপড়-চোপড়ের পাইকারি বাজার থেকে মালামাল কিনে ট্রলিতে ভরে দূর দূরান্তের বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানে পৌঁছে দেয়ার ভারী কাজ। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হলেও যেতে দু’ঘন্টা ফিরে আসতে দু’ঘন্টা এভাবে কঠোর পরিশ্রমে আবার সেই সঞ্চয়ের পালা। এক বছরের মাথায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলেন বৈধতার প্রত্যাশায়, কিন্তু টিকলো না কেস। উপায় একটাই, কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। অন্য সবাই যেভাবে বৈধ হন, সেভাবেই মেহেদিকেও সম্পন্ন করতে হলো চুক্তিভিত্তিক বিবাহ।
পারমানেন্ট রেসিডেন্স কার্ড পেলেন সময়ের ব্যবধানে। এরই মধ্যে অবশ্য একটি কাজের কাজ করে ফেলেন মেহেদি। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর কর্তৃক ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হয়ে যান, যেখানে ক্লাস করাতেন বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দারুণ মেধাবী মেহেদি দ্রুত রপ্ত করলেন স্পেনিশ ভাষা, করলেন ভালো রেজাল্ট। শিক্ষকরাই তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলো বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের লেংগুয়েজ ডিপার্টমেন্টে। ৬ মাসের বিশেষ কোর্সে আবারো ভালো রেজাল্ট। খুলতে শুরু করলো একের পর এক দুয়ার।
একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ওপর ১ বছরের গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোমা অর্জন করলেন মেহেদি। এতোসব পড়াশোনা সবকিছুই তার চলেছে সেই সকাল-সন্ধা দূর-দূরান্তে মালামাল সাপ্লাইয়ের কাজ ঠিক রেখে। কাছের লোকজন নিয়মিত ক্যাসিনোতে যেতো, এমনকি কষ্টার্জিত পয়সা উড়াতো মেয়েদের পেছনেও, কিন্ত আজীবনের ব্যতিক্রমি মেহেদি বরাবরই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত হবার সংকল্পে অবিচল। দেশ থেকে বহু দূরে এসেও নৈতিকতার মাপকাঠি মেপে চলেছেন ঠিকই, কিন্তু ঠকবাজির শিকার হওয়া যেন তাঁর পিছু নিয়েছিলো আর্জেন্টিনার রাজধানীতেও।
হোটেল ম্যানেজমেন্টের ওপর মেহেদির ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফিকেট থাকায় বুয়েনস আয়ার্সের জনৈক প্রবীণ বাংলাদেশি তাঁকে ফুসলিয়ে মাঠে নামায় রেস্টুরেন্টের পার্টনারশিপ ব্যবসায়। চালু হলো রেস্টুরেন্ট কিন্তু সুচতুরভাবে প্রতি মাসে লোকসান দেখানো হলো নবাগত মেহেদিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন কেটে পড়ার। কারি ব্যবসার সমাপ্তি টেনে আবার ফিরে গেলেন পুরনো কাজে, যদিও মোটমুটি একটি ভালো অংকের অর্থ লোকসান হয় তখন। যাকে তাকে বিশ্বাস করে ভুল করলেও সময় মতো আর্জেন্টাইন পাসপোর্টের জন্য আবেদনটি জমা করতে কিন্তু ভুল করেননি মেহেদি।
মাত্র ৩শ’ ইউএস ডলার পকেটে নিয়ে আর্জেন্টিনার মাটিতে পা দিলেও টানা ৬ বছর পথেঘাটে দিন-রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্যাশ করলেন প্রায় ২৫ হাজার ইউএস ডলারের সমপরিমাণ পেসো। বুয়েনস আয়ার্সের প্রাণকেন্দ্রে ট্যুরিস্ট এরিয়া ফ্লোরিডাতে দোকান নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা শুরু করলেন ২০১২ সালে। বৈধ মালেরই ব্যবসা করেন, নিয়মিত ট্যাক্স দেন সরকারকে। বুয়েনস আয়ার্স চেম্বারের সাথেও সম্পৃক্ত হয়েছেন ধীরে ধীরে, অবদান রাখতে চান বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়নে।
ভালো ভাষা জানা এবং নিয়মিত ট্যাক্স পে করার সুবাদে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভ করেছেন আর্জেন্টিনার, যদিও আবেদন করার পর প্রায় দু’বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে তাঁকে। দেশ থেকে দেশান্তরে জীবন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হচ্ছিলেন মেহেদি। শত ব্যস্ততার মাঝেও অবসরে দূরের কোন গ্রামে গিয়ে ঘোড়া দৌড়াতে আনন্দ পান। আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখতে এই সেদিন গিয়েছিলেন ব্রাজিলে। তৃপ্ত হন প্রিয় দলের খেলা দেখে, ভালোবাসেন ফুটবলকে। তার চেয়ে বড় ভালোবাসার বাঁধনে তাঁকে আবদ্ধ করেছেন ইতালিয় বংশোদ্ভুত এক আর্জেন্টাইন।
সামজিকভাবে তাঁদের বাগদানও সম্পন্ন হয়েছে। আসছে জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে যাবার স্বপ্নে বিভোর মেহেদি, সাথে যাবে তাঁর আগামী দিনের জীবন সঙ্গিনী। দেশে-বিদেশে ‘অপচয়’ শব্দটি মেহেদির অভিধানে না থাকলেও নতুন বছরের শুরুতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাকে একটু গ্লামারাস একটু স্মরণীয় করতে সঙ্গিনীকে নিয়ে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে যাবেন সাগর পাড়ের পটুয়াখালিতে। মা-বাবার দোয়া নিয়ে বসবেন বিয়ের পিড়িতে, বাজবে সানাই।