এভিয়েশন নিউজ: ‘যাত্রী পরিষেবায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মান মোটেই একবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিমানকে হতে হবে আরো মানবিক। তাদের কর্মীদের নিতে হবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ। আন্তর্জাতিক মানে নেওয়া প্রয়োজন বিমানবন্দর পরিষেবাও।’ বার্গেস লান নামের একজন ব্রিটিশ যাত্রী সম্প্রতি বিমানের লন্ডন-ঢাকা এবং ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইটে ভ্রমণ করে এমন নেতিবাচক মন্তব্য লিখেছেন আকাশ ভ্রমণ পর্যবেক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘স্কাই রেক্স’-এ।
তিনি বিমানে ভ্রমণের পদে পদে হয়রানির কথা সবিস্তারে লিখেছেন। জার্নালটির ‘নিম্নমানের যাত্রী পরিষেবা’ (দুই তারকা চিহ্নিত) বিষয়ক তালিকায় বিশ্বের ২৪টি এয়ারলাইনসের মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নাম রয়েছে। নিম্নমানের যাত্রী পরিষেবায় পিছিয়ে নেই দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোও।
তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইনস নভোএয়ার, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ সক্রিয় রয়েছে। উড়োজাহাজ সংকটের কারণে সবচেয়ে পুরনো বেসরকারি এয়ারলাইনস জিএমজির ফ্লাইট এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। রিজেন্ট ও ইউনাইটেড চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটেও বিস্তর ভোগান্তি। ফলে যাত্রীরা বিদেশি এয়ারলাইনসের দিকেই ঝুঁকছেন। আর বিমানসহ দেশি এয়ারলাইনসগুলো হারাচ্ছে ব্যবসায়িক সুনাম।
দেশি এয়ারলাইনসগুলোর নিম্নমানের যাত্রী পরিষেবার কথা স্বীকার করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনবিষয়ক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বিমানের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর যাত্রীসেবার মান আরো উন্নত করা প্রয়োজন। বিমানকে লাভজনক করার পাশাপাশি এর যাত্রীসেবার মান বাড়াতে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কিছুটা সাফল্যও পাওয়া গেছে। তবে পুরোপুরি সাফল্য পেতে আরো অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে।’
মন্ত্রী বলেন, রিজেন্ট ও ইউনাইটেডের যাত্রী পরিষেবাও সন্তোষজনক নয়। অবশ্য তাদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বরাবরই সেবার মান বাড়াতে তাদের তাগাদা দেওয়া হয়। বিমানের পাশাপাশি এ দুটি এয়ারলাইনসের যাত্রী পরিষেবার মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হতেই হবে। কারণ তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে দেশের সুনাম জড়িত।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী পরিষেবা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানকার যাত্রী পরিষেবাও আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে বিমানবন্দরের যাত্রী পরিষেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। এখানকার যাত্রী পরিষেবা নিয়ে বিমান পরিচালনা পর্ষদ শিগগির বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়ে এগোবে বলে আশা করছি।’
যাত্রী হয়রানির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসে ই-মেইলে অভিযোগ জানাতে পারেন। এয়ারলাইনসগুলোও সহায়তা করতে পারে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুন রুবি হক নামে সিঙ্গাপুরগামী বিমানের এক যাত্রী মতিঝিলের টিকিট বিক্রয় কেন্দ্রে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও টিকিট কনফার্ম করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, বিমানকর্মীরা টিকিটের জন্য তাঁর কাছে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ চান। রুবি হক এর প্রতিবাদ করলে একজন বিমানকর্মী তাঁকে লাঞ্ছিত করেন।
পরে মতিঝিল থানার পুলিশ সেখান থেকে দুজন বিমানকর্মীকে আটক করে। ওই ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত বিমানকর্মীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। পরে তদন্ত কমিটি গঠন করার পাশাপাশি দুঃখ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতিও দেয় তারা।
কিছুদিন আগে রিজেন্ট এয়ারের কুয়ালালামপুর ফ্লাইট বিলম্বিত হয় ৩৭ ঘণ্টার জন্য। পূর্ব ঘোষণা না থাকায় যাত্রীদের পোহাতে হয় অশেষ ভোগান্তি। এর ফিরতি ফ্লাইটের ঢাকামুখী যাত্রীরাও কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে একই রকম ভোগান্তিতে পড়েন। ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে সবচেয়ে কম ভাড়ায়ও যাত্রী পাচ্ছে না রিজেন্ট।
এ রুটে তাদের সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট থাকলেও যাত্রী মিলছে মাত্র দুটির। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই নির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল, উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তারা দিন দিন যাত্রীপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতা রুটের ফ্লাইটের যাত্রীদের নিয়মিত অভিযোগ, উড়োজাহাজে শীতাতপ যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে দমবন্ধ অবস্থায় পড়তে হয় যাত্রীদের।
জানা গেছে, বিমানবন্দর ও আকাশসীমা ব্যবহার বাবদ সরকারের কাছে তাদের বকেয়া প্রায় ৮৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ অর্থ পরিশোধ ছাড়া তাদের উড্ডয়ন ছাড়পত্র দেওয়ার বিপক্ষে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচক তাদের যাত্রী নিরাপত্তার মান নিয়েও প্রশ্ন তোলে। আদালতের হস্তক্ষেপে উড্ডয়ন ছাড়পত্র না দেওয়ার বিষয়টি এক মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে।
২০০৭ সালের ১০ জুলাই যাত্রা শুরু করে ইউনাইটেড এয়ার। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়াও তাদের রয়েছে জেদ্দা, মাস্কাট, দোহা, কুয়ালালামপুর, কাঠমাণ্ডু, কলকাতাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রুট। একটি উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাস দুয়েক হলো বন্ধ রয়েছে তাদের ঢাকা-ঈশ্বরদী রুটের ফ্লাইট। দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার অংশীদার আছে এয়ারলাইনসটির।
এদিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বিমানকে লাভজনক করতে ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে লিমিটেড কম্পানিতে পরিণত করা হয়। কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টো। প্রতিষ্ঠার পর ৩৬ বছরে যেখানে লোকসানের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, সেখানে কম্পানি করার পর ছয় বছরে বিমানের লোকসান হয়েছে এক হাজার ১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
ভিন্ন একটি সূত্র মতে, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আকাশ পরিবহন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বিমানকে বেসরকারি খাতে দেওয়ার বিকল্প নেই। খ্যাতিসম্পন্ন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মাত্র দুই বছর লোকসান দেওয়ার পর সম্প্রতি বেসরকারীকরণের ঘোষণা এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করা জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনস বিমানের রয়েছে ১৯টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য। এর উড়োজাহাজ বহরে আছে চারটি বোয়িং ৭৭৭, দুটি বোয়িং ৭৩৭ এবং একটি এয়ারবাস ৩১০। ছোট উড়োজাহাজের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে এর অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট।