সোনা চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুট চট্টগ্রাম বিমানবন্দর

Shah_amamat_airportএভিয়েশন নিউজ: সোনা চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুট এখন চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ঢাকার শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় এই অবৈধ ব্যবসার গডফাদাররা তাদের নিরাপদ রুট হিসেবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে বেছে নিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় এই রুটে প্রতিমাসে শত কোটিরও বেশি টাকার সোনা চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সোনা চোরাচালানিদের বাহক হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের প্রকৌশল শাখা, নিরাপত্তা শাখা, যানবাহন ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি জড়িত। এরা চোরাকারবারিদের পক্ষে সোনা বহনকারী হিসেবে কাজ করছে। এদের মূল শক্তি বিমানের শ্রমিক লীগ সমর্থিত সিবিএ।

অভিযোগ রয়েছে, চোরাচালানের এই টাকার ভাগ পাচ্ছেন সিবিএ সভাপতি মসিকুর, সাধারণ সম্পাদক মন্তাছারসহ ৫০ শীর্ষনেতা। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বছরের পর বছর একই স্টেশনে এবং একই শাখায় কর্মরত থেকে চোরাচালানসহ নানা অপরাধ করলেও শাস্তি হচ্ছে না। শাস্তি দিতে কিংবা বদলি করতে গেলেই সিবিএ নেতারা আন্দোলনের হুমকি দেন। বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন জানান, বিমানের সিবিএ’র কাছে জিম্মি পুরো ম্যানেজমেন্ট।

বিদেশী এমডি কেভিন স্টিল পর্যন্ত এই সিবিএ’র কাছে পরাস্ত হয়ে দুদকের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। এরা এতটাই শক্তিশালী যে, বর্তমানে চোরাচালানসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে গেছে। মাস শেষে বিমানের ফান্ড থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলন করলেও বিমানের উন্নয়নে কোনো কাজ করছে না। উল্টো সোনা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, কিছু কিছু সিবিএ নেতাকে পদোন্নতি দিয়ে অফিসার করলেও এরা সে পদোন্নতি নিচ্ছেন না। কারণ অফিসার হলেই সিবিএ’র সদস্য পদ থাকবে না।

এতে তাদের মাসোয়ারা আয়ও কমে যাবে। অপরদিকে সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক মন্তাছার রহমান জানান, বিমানের কোনো সিবিএ নেতা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নন। এ কাজে যারা জড়িত তাদের কাছ থেকে বিমান ম্যানেজমেন্টের টপ টু বটম ভাগ পাচ্ছে। যার কারণে এরা বছরের পর বছর স্বপদে থেকে বহাল তবিয়তে চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধ করে গেলেও শাস্তি পাচ্ছে না।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে যে কোনো ফ্লাইট অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজে সংশ্লিষ্ট বিমানের প্রকৌশল শাখা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মীরা পেশাগত কাজে ওই ফ্লাইটের উড়োজাহাজ ঢোকেন। এরপর কাজের ফাঁকে তারা উড়োজাহাজ থেকে সোনার চালান সংগ্রহ করে নিরাপত্তা শাখার যোগসাজশে ৪, ৮ ও ৯ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে যানবাহন শাখার কর্মচারীদের মাধ্যমে চালানটি ডেলিভারি দিচ্ছেন।

জানা গেছে, ছোট-বড় প্রতিটি চালানের জন্য নিরাপত্তা ইনচার্জকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া যানবাহন শাখার ডেলিভারি ইনচার্জকে দিতে হয় ট্রিপ প্রতি ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর ফ্লাইটের বিভিন্ন স্থান কেটে ও টয়লেটের নাট-বল্টু খুলে চালানের সোনাগুলো বের করে দেয়ার কাজ করছেন বিমানের প্রকৌশল শাখার লোকরা। এ জন্য প্রতি চালানে তারা পাচ্ছেন ১ লাখ থেকে গড়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। জানা গেছে, প্রতিটি চালান খালাসের পর নিরাপত্তা শাখার ইনচার্জ সাত্তারের-পি৩৫৮৭৭ কক্ষে এই টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়। এ কারণে নীরবে-নিঃশব্দে প্রতিদিন পাচারের ঘটনা ঘটলেও সবাই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে চাঞ্চল্যকর সোনা আটকের দুটি ঘটনার বাস্তব অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে। চট্টগ্রাম পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ ফেব্র“য়ারি ৪৯ কেজি সোনা আটক করে শুল্ক ও গোয়েন্দা শাখা। এ ঘটনার সঙ্গে ৪ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী (ক্লিনার) সরোয়ার, জীবন, সুখলালের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। জানা গেছে, ওইদিন দুবাই থেকে আসা দুবাইয়ের একটি ফ্লাইট থেকে প্রকৌশল শাখার কর্মীদের সহায়তায় এই চার ক্লিনার ৪৯ কেজি সোনা তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেঁধে নেয়।

কিন্তু একটি চালান ক্লিনার হারাধনের শরীরে বাঁধার সময় ওই ফ্লাইটের দায়িত্বরত গার্ড মাসুদ হাতেনাতে ধরে ফেলে ও হারাধনকে আটক করে। এরপর শুল্ক ও গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তায় বাকি তিনজনকে তল্লাশি করে চারজনের শরীর থেকে ৪৯ কেজি সোনার বার আটক করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই দিন প্রকৌশল শাখার নিরাপত্তা বিভাগে সাত্তারের ডিউটি না থাকা সত্ত্বেও তিনি রহস্যজনক কারণে ফ্লাইটের নিচে অবস্থান করছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, এরপর গোপনে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে ১৫ লাখ টাকায় দফারফা করে আটক চার পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে ছাড়িয়ে নেন সাত্তার। আর সোনাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার ব্যবস্থা করেন। গত ২০ মার্চ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ৩০ পিস সোনা সংগ্রহ করে নিচে নেমে আসে পরিচ্ছন্নতা কর্মী সুখলাল ও জীবন। কিন্তু তাদের গতিবিধি দেখে সন্দেহ হওয়ায় সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা কর্মকর্তা দু’জনের শরীর তল্লাশি করেন।

এ সময় সুখলালের কাছ থেকে ৩০ পিস সোনার বার উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে তার স্বীকারোক্তি মতে জীবনকেও আটক করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক নিজে উপস্থিত থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা নং ৮ (২০ মার্চ ২০১৪)। এরপর আটককৃতদের মোবাইল কললিস্ট যাচাই করে দেখা যায় সুখলালের নম্বর ০১৭১৮-০৭৯১১৮ থেকে সাত্তারের নম্বরে ০১৭৫৬৩৮০১৯/০১৭২০৫৮৮৫৩০ এবং হারাধনের মোবাইল নম্বর ০১৮১৩৭৯৯৯০৯-এর সঙ্গে সোনা পাচার সংক্রান্ত যোগাযোগের অসংখ্য রেকর্ড রয়েছে।

এছাড়া জীবনের মোবাইল ফোন ০১৮২২৭২১৯৭২ থেকেও যানবাহন শাখার ডেলিভারিম্যান মুকুল এবং সহ-মেকানিকের মোবাইল নং- ০১৬৭০৮৮৯০৭৯/০১৭১২০২৯৬০২ এর মধ্যে অসংখ্যবার যোগাযোগ ও সোনা পাচার সংক্রান্ত বিপুল পরিমাণের ক্ষুদে বার্তার (এসএমএস) রেকর্ড পাওয়া যায়। পরবর্তীতে পুলিশ রিমান্ডেও সংশ্লিষ্ট আটককৃতরা সোনা পাচারের সঙ্গে সাত্তার, হারাধন এবং মুকুলের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেয়া হয়। পুলিশ জানায়, চট্টগ্রামে সোনাসহ বিভিন্ন পাচার কাজে যারা জড়িত তাদের একটি তালিকা তৈরি করে পুলিশ সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এ থেকে পুলিশ দেখতে পেয়েছে তালিকাভুক্তরা প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের স্যালারি অ্যাকাউন্টে জমা করেছে।

মজার ব্যাপার হল, সংশ্লিষ্টরা ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছরে স্যালারি অ্যাকাউন্ট থেকে একটি টাকাও উত্তোলন করেনি। উল্টো প্রতি মাসে ওই অ্যাকাউন্টে গড়ে ১ লাখ টাকার উপরে জমা হওয়ার রেকর্ড পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্টদের চাকরি ব্যতীত অন্য কোনো আয়ের বৈধ উৎসও নেই।

চক্রের সদস্য কারা : চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান চক্রের সবচেয়ে ফলপ্রদ উপকারীর ভূমিকা পালন করছে বিমানের প্রকৌশল শাখা। কারণ উড়োজাহাজ নামার পর তার ভেতরে ঢোকার সুযোগ এই শাখার লোকজনেরই শুধু রয়েছে। অন্য কোনো বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রবেশ খুবই সীমিত। এ সুযোগে প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিমানের টয়লেট, গালি, এমনকি ইঞ্জিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বক্স কেটে সোনা চোরাচালান করছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই শাখার মধ্যে সাত্তার, হারাধন, নির্মল, সরোয়ার, সাহাদাত, গোবিন্দ, বিক্রম, নজরুল, মরন, রবিন, রিয়াজুল কবির অন্যতম।

সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৬০ কেজি সোনাসহ আটক প্রকৌশল শাখার গ্রেফতারকৃত কর্মচারী মোবাইলের কললিস্টেও এদের মোবাইল নম্বর পেয়েছে পুলিশ। বর্তমানে তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। জানা গেছে, প্রকৌশল শাখার সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিু স্তরের ব্যক্তিরা বিমানের অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘ম্যানেজ’ করে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কর্মরত। এদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাদের অন্যত্র বদলি কিংবা শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

নিরাপত্তা শাখা : জানা গেছে, এই শাখার ফজলুল হক, মোবাইল নং ০১৭১১৪৩৪১৭০, মহিম মোবাইল নং ০১৮১৬৮১৩২৮১, যানবাহন শাখার সরোয়ার কায়নাত মুকুল, মোবাইল নং ০১৬৭০৮৮৯০৭৯/০১৭১২-০২৯৬০২, পলাশ কান্তি দে’র (০১৮১৮-১৯৭৪২২) নম্বরগুলোও বর্তমানে গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। ইতিমধ্যে এসব নম্বর থেকে পুলিশ চোরাচালানের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও পেয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, যানবাহন সুপারভাইজার আরিফ, মোবাইল : ০১৭১২-৯৩৬৪৯২, বিমান কেন্টিনের বয় সেলিম, মোবাইল ০১৮১৩৩৩৪৬৬, সোলেমানের মোবাইল নম্বরগুলো থেকেও চোরাচালান সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান হয়েছে। পুলিশ এসব তথ্য খতিয়ে দেখছে। পুলিশ জানায়, ২০ মার্চ গ্রেফতারের সময় সুখলাল ও জীবনের পরনে ছিল বিমানের ইউনিফর্ম।

অভিযোগ আছে, সন্ধ্যায় থানায় গিয়ে তাদের সহযোগী সরোয়ার ও সাত্তারকে বিমানের ইউনিফর্ম খুলে নিয়ে ওই দুজনকে সিভিল শার্ট পরতে দেয়। এ কাজে সহায়তা করার জন্য বিমানকর্মী মুকুলের বিরুদ্ধে পুলিশকে এক লাখ টাকা ঘুষ দেয়ারও অভিযোগ আছে। আর এই টাকা বিকাশের মাধ্যমে প্রদান করার তথ্যও তদন্ত সংস্থা খুঁজে পেয়েছে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের অভিযোগে চার বিমানকর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছে। এরা হল আলমগীর, এরশাদ, রফিক ও মহিউদ্দিন। একই ঘটনায় বর্তমানে কারাগারে আছে সুখলাল ও জীবন।

– মুজিব মাসুদ, চট্টগ্রাম থেকে ফিরে

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.