এভিয়েশন নিউজ: রাজধানীতে রেভ্যুলেশন বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে হেলথ কার্ড করিয়ে দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশী-বিদেশী হাসপাতালে লোভনীয় ডিসকাউন্টের কথা বলে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তারা এসব হেলথ কার্ড করায়। পরে কার্ডধারীরা কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা-তো পানই না, উল্টো পদে পদে ভোগান্তির শিকার হন।
রাজধানীর গ-১৯, লেভেল-৪, মহাখালী সি/এ (ঢাকা ব্যাংকের পেছনের গলি) ঠিকানায় রেভ্যুলেশন বাংলাদেশ লিমিটেডের অফিস। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশী কিছু হাসপাতালে তাদের সামান্য কিছু যোগাযোগ থাকলেও বিদেশী হাসপাতালের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই।
অথচ তারা প্রচার করে থাকে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা হাসপাতালগুলোর কর্পোরেট অ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে। তবে দেশের বাইরের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে রেভ্যুলেশন বাংলাদেশ লিমিটেডের যোগাযোগ বা কর্পোরেট অ্যাগ্রিমেন্টের কোনো ধরনের কাগজপত্র দেখাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফয়সাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আসলে এটা আমাদের বিজনেস পলিসি। বাইরের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ব্যবসার জন্য করতে হয়, কিছু করে তো খেতে হবে।’
যোগাযোগ না থাকার পরও সাধারণ অসহায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার কারণ জানতে চাইলে একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ফয়সাল হোসেন। শুধু তাই নয়, এ নামসর্বস্ব হেলথ কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে মোটা অংকের ডিসকাউন্টসহ চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং গ্যারান্টিসহ ভিসা করিয়ে দেয়ার নাম করে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। রেভ্যুলেশনের এসব মিথ্যা আশ্বাস এবং প্রতারণার খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক অসহায় গরিব রোগী। সাত দিনে ভিসা করার নাম করে ঘুরতে হয়েছে মাসের পর মাস।
কার্ড করার সূত্র ধরে তথ্য অনুসন্ধানে রেভ্যুলেশনের হট নম্বরে যোগাযোগ করলে সেখানকার এক কর্তব্যরত নারী ই-মেইলে কোম্পানির নামসহ আবেদনকারীর বিস্তারিত পাঠাতে বলেন। কিন্তু অফিসে যেতে চাইলেও তিনি এই প্রতিবেদককে অফিসে আমন্ত্রণ জানাননি। পরে রেভ্যুলেশনের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জরাজীর্ণ একটি ভবনের চার তলায় তিনটি ছোট্ট রুমে চারজন বসে অফিস করেন। অথচ এই অফিস থেকেই গ্যারান্টিসহ ভিসা, বাইরের হাসপাতালে বিশাল অংকের ডিসকাউন্টসহ লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে হেলথ কার্ড এবং ভিসার প্রতারণা ব্যবসা করা হয়।
রেভ্যুলেশনের খপ্পরে পড়েছিলেন কবির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘আমাকে নানা ধরনের অফার আর ডিসকাউন্টের কথা বলে আমার অফিসে এসে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে হেলথ কার্ড করান কয়েকজন তরুণ-তরুণী। পরে সেই হেলথ কার্ড আমার কোনো কাজেই লাগেনি, উল্টো বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ আমার চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তখন আমি রেভ্যুলেশনের সাহায্য চাই। এ সময় রেভ্যুলেশন আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভিসা, চিকিৎসা এবং ব্যাংকক হাসপাতালের ইনভাইটেশন লেটার আনিয়ে দেয়ার নাম করে কয়েক লাখ টাকা নেয়।’
‘দ্রুত ভিসা দেয়ার নাম করে প্রতিষ্ঠানটি ২৪ জুন আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট নেয়। পরে ব্যাংকক হাসপাতালের সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগ শেষ করে ৬ জুলাইয়ের মধ্যে ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করে তারা। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ভিসা করিয়ে দিতে ব্যর্থ হলে কালক্ষেপণ করে রেভ্যুলেশন।
এরপর দীর্ঘদিন ভোগান্তির পর ২৪ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা ভিসা করিয়ে দিতে ব্যর্থ এবং টাকা ফেরত দিতেও অপারগতা জানায়। এদিকে আমার শরীরের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরে রেভ্যুলেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা উত্তরার নর্দার্ন ট্যুরসের মাধ্যমে ব্যাংককের ভিসা করিয়ে দেবে। এভাবেই দীর্ঘদিন ঘোরানোর পর কোনোমতে রেভ্যুলেশন তাদের দায়িত্ব শেষ করে’ বলেন ওই ব্যবসায়ী।
রেভ্যুলেশনের প্রতারণার গল্প বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নর্দার্নও কয়েক দফা আমাকে ঘুরিয়েছে। এ অসুস্থ শরীরে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করতে গিয়ে আমি এবং আমার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
এভাবে প্রতিনিয়তই অসংখ্য কবির হোসেনের সঙ্গে প্রতারণা করে রেভ্যুলেশন এবং নর্দার্ন ট্যুরসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। কবির হোসেন কাক্সিক্ষত ভিসার দেখা পেলেও অনেকের কপালে জুটেছে রেভ্যুলেশন এবং নর্দার্ন ট্যুরসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পেটুয়া বাহিনীর ভর্ৎসনা-ভয়ভীতি। নিঃস্ব-গরিব রোগীদের প্রতারিত হওয়ার কাহিনী আরও করুণ।
এ ব্যাপারে ফয়সাল হোসেন বলেন, মেডিকেলসেবাটা এবারই প্রথম দিচ্ছি, তাই একটু ঝামেলা হচ্ছে। টাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ভাই আমাদের অনেক কিছু ম্যানেজ করতে হয়, টাকা তো লাগবেই। ভিসা দিতে দেরি হওয়ার এই দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে আমার প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ অফিসার একটু মিথ্যা বলেছেন। মাঝে ঈদের ছুটি ছিল, সবকিছু মিলিয়ে একটু দেরি হয়ে গেছে।
নর্দার্ন ট্যুরসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ বলেন, এখানে আমাদের কোনো দোষ নেই। রেভ্যুলেশন আমার ক্লায়েন্ট, আমার বোঝাপড়া তাদের সঙ্গে। তবে হ্যাঁ আমার প্রতিষ্ঠানের হেড অব অপারেশন ম্যানেজার রাসেল ক্লায়েন্টকে বেশ কয়েকবার মিথ্যা বলেছে।
রেভ্যুলেশন প্রসঙ্গে বুলবুল আহমেদ বলেন, তাদের হেলথ কার্ড অফারটি একদম ভুয়া। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মেম্বারশিপ কার্ডটি নিয়েছিলাম, তবে তেমন কোনো কাজে লাগেনি।
জানা যায়, রেভ্যুলেশন এবং নর্দার্ন ট্যুরস বিভিন্নভাবে কবির হোসেনের পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ২৩ জুলাই ছিল ঈদের আগে পাসপোর্ট ডেলিভারির শেষ দিন। এর আগে ২২ জুলাই ভিসার জন্য দূতাবাসে পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন বলে কবির হোসেনের কাছে দাবি করেন রেভ্যুলেশনের এক্সিকিউটিভ লিটু আনাম। সেদিন পাসপোর্ট জমার রিসিপ্ট কপিটি দেখতে চাইলে সেটা দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠান দুটি। এভাবে নানাভাবে প্রতিষ্ঠান দুটি প্রতারণা করে। এদিকে কবির হোসেনের শারীরিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে।
রেভ্যুলেশনের এই হেলথ কার্ড এবং ভিসা-বাণিজ্যের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালে একটি ছোটখাটো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করে রেভ্যুলেশন। পরে মহাখালীতে অফিস নেয়ার পর ফার্মটি হয়ে যায় হেলথ কার্ড এবং ভিসাসংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান কেন্দ্র। এরপর শুরু হয় ফয়সালের নতুন ধান্দা।
জানা যায়, হেলথ কার্ড করানোর জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ দেন ফয়সাল হোসেন। এসব আধুনিক তরুণ-তরুণী কমিশন বা বেতনের ভিত্তিতে কাজ করেন। তাদের কাজ হল বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে গিয়ে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নানা অফার আর ডিসকাউন্টের কথা বলে হেলথ কার্ড করতে রাজি করানো।
পরে রোগীকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্য গ্যারান্টিসহ ভিসারও অফার করেন। এভাবেই রোগীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে রীতিমতো ফাঁদে ফেলে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রেভ্যুলেশন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় প্রতিনিয়ত শত শত মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন।