ধরা ছোঁয়ার বাইরে চট্টগ্রাম বিমানের সোনা চোরা-কারবারীরা!

Gold_Sonaমিজানুর রহমান মিজান, এভিয়েশন নিউজ, চট্টগ্রাম থেকে: এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বাংলাদেশ বিমানের চট্টগ্রাম অফিসের দুর্নীতিবাজ ও সোনা চোরা-কারবারীরা। অভিযোগ খোদ বিমানেরই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তাদের শেল্টার দিচ্ছে। এখনো বহাল তবিয়তে আছে যানবাহন শাখার ইনচার্জ আরিফুর রহমান ও তার সিন্ডিকেটের মুল হোতারা। তাদের বিরুদ্ধে করা তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি করে চক্রটিকে কৌশলে রক্ষা করার চেষ্টা চলছে। এই কাজে লাখ লাখ টাকার আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হওয়ারও অভিযোগ আছে। এই ঘটনাটি এখন বিমানের চট্টগ্রাম অফিসে টক অব দ্যা সিটি হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে। যার কারণে বহাল তবিয়তে আরো দ্বিগুন উৎসাহে সিন্ডিকেট চোরাচালান অব্যাহত রেখেছে। চট্ট্রগাম পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমানের প্রধান কার্যালয় সুত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চট্টগ্রাম স্টেশনের যানবাহন শাখার বিরুদ্ধে এর আগে ব্যপক দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও উপর মহলের আর্শিবাদে উক্ত শাখার ইনচার্জ আরিফুর রহমান (পি নং-৩৫৪৫০) লোমহর্ষক অনিয়মের সাথে সেকশন পরিচালনার মহড়া দিয়ে চলছে।

জানা গেছে, গত ১৭ ও ১৮ মে উক্ত শাখায় কর্মরত সহ-মেকানিক জহিরুল ইসলাম (সি-০১৫১) অফিসে অনুপস্থিত ছিল। যার কারণে দৈনিক হাজিরা শীটে ছুটি তাকে দেখানো হয়। কিন্তু অভিযোগ মাস শেষে তাকে হাজিরা রেজিস্টারে উপস্থিত দেখিয়ে ডিউটি এবং ওভারটাইমসহ বেতন প্রদান করা হয়। বিনিময়ে আর্থিক ভাবে উপকৃত হন ওই শাখার ইনচার্জ আরিফুর রহমান।

জানা যায় ১ জুলাই বিমানের গাড়ী নং ৫১২৭ দ্বারা সাধারণ পালা পিক আপের সময় অপারেটর ওবায়েদুর রহমান (যিনি চট্টগ্রাম স্টেশনে ১৫ বছর যাবত আছেন) তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বিমান বন্দরের প্রবেশ মুখে সাম্পান ভাস্কর্যের সামনে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রোড ডিভাইডারে প্রদর্শিত সাইন বোর্ড ভেঙ্গে ফেলেন। পরবর্তীতে তাকে উক্ত সাইন বোর্ড বিমান বন্দর ব্যবস্থাপকের নির্দেশক্রমে স্ব-উদ্যোগে মেরামত করতে বাধ্য হয়।

অফর দিকে বিমানের ওই গাড়ীটি দীর্ঘ দিন অচল অবস্থায় থেকে গত ৬ আগস্ট পূনরায় সচল করা হয়। অভিযোগ রয়েছে সচল হওয়ার পর গাড়ী বিআরটিএ হতে ফিটনেস করানোর জন্য একই মডেলের অন্য গাড়ীর যন্ত্রাংশ খুলে লাগানো হয়। তবে মজার বিষয় হলো দুর্ঘটনাকালে বিমানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গাড়ীতে থাকলেও অভিযোগ রযেছে রহস্যজনক কারণে তিনি সংশ্লিষ্ট ঘটনার বিরুদ্ধে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেন নাই।

আরও জানা যায় গত ২১ জুলাই একই অপারেটর গাড়ী নং ৫১৩৩ দিয়ে আরিফুর রহমান ও নিরাপত্তা ইনচার্জ ফজলুল হক বিকেল ৫ টায় বিজয় নগরে ড্রপ নেওয়ার সময় বিজয় নগরের প্রবেশ মুখে কার নং চট্টমেট্রো-গ-১১-৬৮১৫ এর সাথে সংঘর্ষ হয়। পরে স্থানীয় জনগনের সহায়তায় উক্ত কারটি মেরামতের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানা দেয়।

ইনচার্জ এমটি ও ইনচার্জ নিরাপত্তা উভয়ই শিফটিং ডিউটি করেন। যার কারণে বিকেল ৫ টায় বিমানের গাড়ী দ্বারা পিক আপ ড্রপ আইনসিদ্ধ না হওয়ায় যানবাহন শাখার ডিউটি রেজিস্টার ও নিরাপত্তা চেকপোস্টের রেজিস্টারে এটি এন্ট্রি করা হয়নি। বিমানের গাড়ী দিয়ে রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি না করে অবৈধ কাজ করা সম্ভব যা এই ঘটনার অন্যতম প্রমাণ।

উল্লেখ্য যে প্রাইভেট কারের মেরামত কাজ জরুরী ভিত্তিতে করা হলেও বিমানের গাড়ীর ক্ষতিগ্রস্থ সামনের বাম পাশের দরজা, বাম্পার ইত্যাদি মেরামত করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে যানবাহন ইনচার্জ আরিফুর রহমান নিরাপত্তা ইনচার্জ ফজলুল হক (জুনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা) এবং ফেরদৌসী বেগম (জুনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা) এই ৩ (তিন) জনের ব্যাক্তিগত কাজে দৈনিক ১০/১২ বার পিকআপ ড্রপের জন্য একটি গাড়ী নিয়োজিত থাকে।

উক্ত ৩ বিমান কর্মীর রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি শুরুর সময়ে এমটির গাড়ী দিয়ে পিকআপ হয়েছে এমন তথ্য ডিউটি রেজিস্টারে নেই এবং কোন সময়ও ডিউটি স্লিপে তারা ব্যবহারকারী হিসাবে স্বাক্ষর করেন না। কারণ উক্ত স্বাক্ষর ওভার টাইম গ্রহণের অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সোনা চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ায় উক্ত শাখার কর্মচারী পলাশ কান্তি দে (অপারেটর), সরোয়ার কায়নাত মুকুল (ক্লিনার) কে কেন্দ্রীয় যানবাহন শাখার নির্দেশে জেলা অফিসে ডিউটি ন্যাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে পলাশকে এপ্রোন ডিউটিতে নিয়োজিত না করা এবং মুকুলকে ২ ঘটিকার পরে বিমান বন্দরে না থাকার শর্তে সেকশনে প্ররণ করা হয় (ইমেইলের মাধ্যমে উক্ত নির্দেশনা ঢাকা হতে চট্টগ্রামে আসে)।

বাস্তবে দেখা যায় ইনচার্জ আরিফের প্রত্যক্ষ মদদে এরা দুজনেই উক্ত অর্ডার অগ্রাহ্য করে চলেছে। গত ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের যানবাহন শাখায় দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে এভিয়েশন নিউজে প্রকাশিত সংবাদে বিমান প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় বলে জানা যায়।

কিন্তু তদন্তের কাজ যেন ঢাকা থেকে নিযুক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা দ্ধারা না হয় সে জন্য এমটি ইনচার্জ আরিফ সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং প্রাথমিক ভাবে সফলও হয়। জানাগেছে শেস পর্যন্ত তার আপ্রাণ চেষ্টায় বিমান চট্টগ্রামের জুনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা ফেরদৌসী বেগমকে দিয়ে তদন্ত করানোর সিদ্ধান্ত নেয় কতৃপক্ষ। কিন্তু এই তদন্ত নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃস্টি হয়েছে চট্টগ্রাম জুড়ে।

অভিযোগ উঠেছে, ফেরদৌসি বেগম মুলত ৪টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে দায়সারা তদন্ত সম্পন্ন করেছে। এই ক্ষেত্রে আরিফকে বাঁচানোর সব ধরনের চেষ্টা চালানো হয় তদন্তে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তদন্তটি এমনভাবে করানো হয়েছে, যাতে চট্টগ্রামে অনিয়ম দুর্নীতির বিস্তৃতির বিষয়ে নিরাপত্তা শাখার উদাসিনতার বিষয়টি প্রমাণিত না হয়। সময়ে অসময়ে এমটির গাড়ী ব্যবহারে যেন বিঘ্নতা না ঘটে সেজন্যও তদন্তটি দায়সারা ভাবে করা হয়েছে।

এছাড়া সুষ্ঠু তদন্ত হলে বিমানের আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অডিট পর্যন্ত গড়াতে পারে। যার কারণে আরিফসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের জটিলতা নিরসনের জন্য একপেশে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করা হয় কৌশলে। তদন্ত প্রতিবেদনে যে সব বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে জায়েজ করানোর চেষ্টা করা হয়েছে

অপারেটর হারুন ও ওবায়দুর রহমান ২ জন ২ শিফটে সিডিউলিং করে থাকে। আবার ওবায়দুর রহমানের সাথে ইনচার্জ আরিফ শিফটিং ডিউটি করেন বলে জানানো হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা যায় এক জন অপারেটরের সাথে সুপারভাইজার আরিফের শিফটিং ডিউটির মাধ্যমে ওভারটাইম গ্রহণের জন্য নতুন এডমিন অর্ডারের প্রয়োজন হবে। যা বর্তমান প্রচলিত আইন দ্ধারা সিদ্ধ হবেনা।

কক্সবাজারে গমনের ক্ষেত্রে ২ মার্চকে টেম্পারিং করে ৩ মার্চ ২০১৪ দেখানো ছুটির দরখাস্তের ফটোকপি উপস্থাপন করা হয়নি। ৩/৪ মাস কোন দাপ্তরিক কাজের রেকর্ড উক্ত সুপারভাইজারের আছে কিনা তাও উলে­খ করা হয়নি। গাড়ী নং ৫১৪১ এর দুর্ঘটনা বাবদ আদায় কৃত টাকা ২ হাজার ২শ টাকা মেরামতে খরচ হয়েছে।

বাকী ১ হাজার ৮শ টাকা দিয়ে যে সকল মেরামতের কথা বলা হয়েছে তার অ্যাকসিডেন্ট/ডেন্টিং সংগঠিত হওয়ার দিনক্ষণ বা লগ এন্ট্রি আছে কিনা তা বলা হয়নি। অপারেটর পলাশ এ্যাপ্রোন ডিউটিতে অধিক মাইলেজের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে উক্ত ডিউটির নীচে প্রকৌশলীর ড্রপ দেখিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন তদন্তকারীর পরামর্শে। জানা যায় এ্যাপ্রোন ডিউটি লেখা কলমের কালী ও লেখার স্টাইলের সাথে প্রকৌশলী ড্রপ লেখা স্টাইলের সাথে মিল নেই।

আরও লক্ষনীয় বিষয় হলো ডিউটি রেজিস্টারে প্রকৌশলী ড্রপ লেখার স্থান সংকুলান না হওয়ায় এক লাইনে ২টি ডিউটি লেখা হয়েছে। বাস্তবতা হলো উক্ত এ্যাপ্রোন ডিউটিতে নিয়োজিত মাইক্রো বাস নং ১৯৫২ দ্ধারা অন্য ডিউটি সাধারণত করানো হয় না। এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টে কিছু বলা হয়নি।

হোটেল বিল হতে বিমানের গাড়ী প্রদানের জন্য বিল না করার যুক্তির বিপরীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রশ্ন করতে ভুলে গেলেন যে একজন প্রকৌশলী/ক্রু কয়টি ব্যাগেজ থাকলে দুটি মাইক্রোবাসের দরকার হয়? কে সেই মাইক্রোবাস ব্যবহারকারী প্রকৌশলী/ক্রু? সহ-মেকানিক মুকুল বিগত ৬ মাসের মধ্যে কত দিন বিকালে এবং কত দিন সকালে ডিউটিতে ছিলেন তারও পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি তদন্ত রিপোর্টে।

যে সকল বিষয় কৌশলে তদন্তকারী কর্মকর্তা এড়িয়ে গেছেন
হরতাল-অবরোধের কারণে বিমানের গাড়ী চলে মাত্র ৩০ শতাংশ, অথচ ওই সময়ে জ্বালানীর ব্যয় কেন অধিক হলো তার কোন প্রশ্নোত্তর নেই তদন্ত নথিতে। বিগত ১৫ এপ্রিল বিজি ০২৭ ফ্লাইটে চড়ে সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় চট্টগ্রাম এসে হাজিরা স্বাক্ষর করেন ইনচার্র্জ আরিফ।

অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা তার ফ্লাইট কুপন সংগ্রহ এবং সে বিষয়ে কোন প্রশ্নোত্তর করেননি তদন্ত রিপোর্টে। গত ১৮ এপ্রিল আরিফ স্টেশন ত্যাগের অনুমতি ব্যতিত চট্টগ্রাম থেকে ফেনী যান একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য। দেখা গেছে তদন্ত রিপোর্টে এ বিষয়ে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা হযনি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠানের বধু বরণ ও খাবার টেবিল ইত্যাদির ভিডিও ফুটেজে আরিফের ছবি থাকার পরও এবিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার রহস্যজনক নিরবতা ও প্রশ্নোত্তর না করার বিষয়টি রহস্যজনক।

তারা বলেছেন, এসব কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এসব দুর্নীতিবাজদের খুঁটির জোর কোথায়। কেন এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তি মুলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? একই ভাবে কিভাবে এসব দুর্নীতিবাজরা বছরের পর বছর একই স্টেশনে এবং একই শাখায় কর্মরত থাকছে।

তাদের মতে, এমনিতে বিমান একটি লোকসানী প্রতিষ্ঠান। কাজেই বিমানকে লাভজনক করতে হলে অবশ্যই অবিলম্বে এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথা যে লাউ সে কদু হয়ে থাকবে বিমান!

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.