ঘুরে আসুন সম্রাট অশোকের স্মৃতিধন্য রাংকুট বনাশ্রম

Rankut-bg20160416173450কক্সবাজার থেকে রামু হয়ে হাতের ডানপাশ ধরে চলে গেছে এক লেনের পাকা রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে শিকলঘাটা বেইলি সেতু পেরিয়ে রাজারকুল ইউনিয়ন। এই রাজারকুলেই অবস্থিত বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক রাংকুট (রাং-উ) বনাশ্রম মহাতীর্থ মহাবিহার।

রাংকুট মহাবিহারটির অবস্থান বলতে গেলে রাস্তার পাশেই। মহাবিহারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উপাসনারত বুদ্ধের মূর্তি দেখে। ফটকের ডানপাশে রয়েছে উপাসনারত ৩৫টি বুদ্ধ মূর্তি। আর হাতের বামপাশে রয়েছে ৫০টি।

এর একটু সামনেই রয়েছে রাংকুট (রাং-উ) বনাশ্রম মহাতীর্থ মহাবিহারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ জগতচন্দ্র প্রজ্ঞাজ্যোতি চন্দ্রজ্যোতি স্মৃতি মন্দির।

প্রায় ১৪’শ বছর আগে সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাং-এর ভারত ও বাংলাদেশে বুদ্ধের অবস্থানস্থল আবিষ্কারের সময়ে রোপিত ৩য় বটবৃক্ষটি রয়েছে মূল আশ্রমের পাশেই। এই বটবৃক্ষের ছায়াতলে রয়েছে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ত্রিপিটক হাতে সম্রাট অশোক মহারাজার ২৩ ফুট উচু ভাস্কর্য।

মূল মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তি দর্শন করতে হলে আপনাকে ৬৭টি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। ওপরে উঠেই দেখা যায়, ছোট-বড় পাশাপাশি চারটি বৌদ্ধমূর্তি। যার একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের (বুড়া গোঁয়াই) মূর্তি। তাছাড়া রয়েছে ১ হাজার ৫০০ বছরের পুরনো তৎকালীন আরাকান রাজা কর্তৃক স্থাপিত শ্বেতপাথরের বুদ্ধের মূর্তি।

 

প্রাচীন আরাকান সম্রাজ্যের দুই বণিক তপসসু ও ভল্লিক-এর ফাং (নিমন্ত্রণ) গ্রহণ করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এই দুই বণিক তাদের ফাং’য়ের কথা তৎকালীন আরাকান রাজা মহাচন্দ সুরিয়াকে জানান। রাজা খুশি হয়ে গৌতম বুদ্ধকে পুনঃনিমন্ত্রণ জানালে তিনি তাঁর প্রধান শিষ্য আনন্দকে নিয়ে পদব্রজে এই দিক দিয়ে গমন করেন এবং বর্তমান এই মহাবিহারে স্থানে উপবেশন করেন (বিশ্রামের জন্য থামেন)। তখন তিনি তাঁর শিষ্য আনন্দকে বলেছিলেন, এইখানে নিকট ভবিষ্যতে তাঁর বক্ষাস্থি দিয়ে একটি চৈত্য (বৌদ্ধ মন্দির) নির্মিত হবে। এই জায়গার নাম হবে রাং-উ। ‘রাং’ অর্থ বক্ষ, আর ‘উ’ অর্থ অস্থি অর্থাৎ ‘রাংউ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বক্ষাস্থি’। বর্তমানে ইহার নাম রাং-কুট(বক্ষাস্থি সম্বলিত পাহাড়)।

পরবর্তীতে সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে খৃষ্টপূর্ব ২৬৮ অব্দে এই মহাবিহার স্থাপন করেন। সম্রাট অশোক সারা পৃথিবীতে ৮৪ হাজারটি এইরকম চৈত্য স্থাপন করেন, যা গৌতম বুদ্ধের ৮৪ হাজার ধর্মবাণীর স্মারক বহন করে। যার একটি বাংলাদেশে রামুতে অবস্থিত রাংকুট বনাশ্রম মহাতীর্থ মহাবিহার।

রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু শাসন বংশ বলেন, ধারণা করা হয়, রাং-উ থেকেই রামু শব্দটির উৎপত্তি। রামুতে ৩০টির মতো বৌদ্ধবিহার থাকলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাংকুটের গুরুত্ব বেশি। বিহারটি বর্তমান পরিচালক ভদন্ত জ্যোতি সেন থের। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত থাইল্যান্ডের নাগরিক। মূলত দানের মাধ্যমেই চলছে সমস্ত ব্যয়। এই বিহারে অধ্যক্ষ আছেন ৮জন আর শিষ্য আছেন ৩৩ জন। এলাকাবাসী তাদের দু’বেলা খাবারের সংস্থান করেন। ভোর ৫টায় সকালের খাবার নিয়ে আসেন তারা। আর দুপুরের খাবার আশ্রমের শিষ্যরা ভিক্ষা করে নিয়ে আসে। মূলত ভাত আর তরকারি ভিক্ষা করে আনা হয়। আশ্রমের দুইপাশ উত্তর ও দক্ষিণ দিক ভাগ করে একদিন পর পর ভিক্ষা করতে বের হন তাঁরা। ভিক্ষা করে আনা খাবারে তাদের চাহিদা সংকুলান হয় না তাই প্রতিদিনই আলাদা করে রান্না করতে হয়।

তিনি বলেন, আশ্রমে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। সরকারি অনুদানে শুধু মাত্র বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে এক-দেড় টন চাল আসে। ব্যক্তিগত অনুদান আর দানবক্স-এর ওপর ভরসা করেই চলে সবকিছু।

যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিহারটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না বলেই মতামত এলাকাবাসীর। এই বুদ্ধ বিহারটিকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হলে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পুরাকীর্তি হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর বিশ্ব পর্যটনের মানচিত্রে অন্যতম দুর্লভ স্থান হিসেবে উঠে আসবে রাংকুট।

যেভাবে যাবেন: কক্সবাজার থেকে সিএনজি করে সরাসরি যেতে পারেন। তাছাড়া, বাসে করে রামু গিয়ে সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশাতেও যেতে পারেন রাংকুট।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.