এভিয়েশন নিউজ: আটক অবৈধ সোনার সব চালান রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে জমা হচ্ছে না। জব্দ করা চালানের তালিকা হওয়ার আগেই একটি চক্র সেখান থেকে কৌশলে সোনা সরিয়ে ফেলছে। ফলে আটকের প্রকৃত পরিমাণও জানা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে সোনা জমা দেয়া হয় শুধু সেটুকুর হিসাবই পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে উদ্ধারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া সোনার হিসাবে ব্যাপক পার্থক্যের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রটি আটক সোনা সরানোর কাজটি নিপুণ দক্ষতায় সম্পন্ন করে। ফলে সোনা লোপাটের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে না। পরবর্তীকালে বোঝা যায়। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকে না। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যায়। এসব ঘটনার তদন্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উচ্চ পর্যায়ের সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কাস্টমস, বিমান, পুলিশ, বিজিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছরে তাদের ভল্টে জমা হয়েছে ১ হাজার ২৪২ কেজি সোনা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দেয়া কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা অফিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৫ বছরে তাদের আটককৃত সোনার পরিমাণ সাড়ে ৮০০ কেজি। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ, জিআরপি, বিজিবি, এপিবিএনসহ অন্যান্য সংস্থা এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৪০০ কেজি সোনা আটক করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এর বাইরে ওজন করা হয়নি এমন ১ হাজার ৬৯৩টি সোনার বার ও ৬৮টি সোনার চেইন উদ্ধার করা হয়। এই পরিমাণ সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা নেই। ভুয়া মালিক সেজে মামলার মাধ্যমে উদ্ধারকৃত বড় বড় সোনার চালান ছাড় করিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, গত এক বছরেরও বেশি সময়ে রেকর্ড পরিমাণ সোনা, বৈদেশিক মুদ্রাসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। আটক চোরাই পণ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতেই তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য গত সপ্তাহে সাত সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এর আগে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা চোরাই পণ্য আটকের পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্তের সুপারিশ করেছে। এনবিআর চেয়ারম্যানও ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি তদন্তে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
ভারতসহ প্রতিবেশী দেশে সোনা পাচার হচ্ছে কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মইনুল খান বলেন, ভারতে পাচার হচ্ছে বা প্রতিবেশী দেশে পাচারের জন্যই যে সোনা আসে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে সোনা আটকের বিষয়টি দেখে বোঝা যায়, ভারতে সোনা পাচার হয়। এর আগে মার্চ মাসে কলকাতা থেকে ৪১ কেজি সোনাসহ তৃণমূল কংগ্রেসের দুই সদস্যকে আটক করে বিএসএফ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা পাচারের কথা স্বীকার করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সোনার কাস্টডিয়ান হিসেবে কাজ করে। এখানে শুধু সোনা জমা রাখা হয়। আর মামলা নিষ্পত্তির পর আদালত নির্দেশ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফেরত দেয়া হয়। আর বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিলে রিজার্ভে যোগ করে বাজারে টাকা ছাড়া হয়। তিনি বলেন, গত ৫ বছরেও সোনার কোনো নিলাম হয়নি।
কাস্টমসের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে বিমানবন্দর থেকে ১২ কেজি, ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২ সালে ২৪ কেজি, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮০০ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে আটককৃত ১২৪ কেজি, ১০৭ কেজি এবং ১০৫ কেজির সোনার তিনটি বড় চালান ছিল। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আটক করা হয় ৩৪ কেজি ৩৫০ গ্রাম। আগস্টে ২৬ কেজি ২৮০ গ্রাম। সেপ্টেম্বরে ১৩ কেজি ৯৩০ গ্রাম। অক্টোবরে ৪ কেজি ৫০০ গ্রাম। নভেম্বরে ৪০ কেজি ৭৩০ গ্রাম। ডিসেম্বরে ৩১ কেজি ৭৫০ গ্রাম। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আটক সোনার পরিমাণ ৬ কেজি ২৭০ গ্রাম। ফেব্র“য়ারিতে ৮৮ কেজি ৭৭০ গ্রাম। মে মাসে ২২ কেজি ১২০ গ্রাম এবং জুন মাসে আটক করা হয় ২৩ কেজি ৯০ গ্রাম সোনা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করছে অবৈধপথে তার ৩-৪ গুণের বেশি সোনা ঢুকছে দেশে। এরপর বিভিন্ন পথে এ সোনা পাচার হচ্ছে ভারতসহ পার্শ^বর্তী বিভিন্ন দেশে। অভিযোগ সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কাস্টমস, শুল্ক ও গোয়েন্দা, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু সদস্যদের যোগসাজশে সোনা পাচার হচ্ছে। এছাড়া আটককৃত সোনার বড় বড় চালান সংশ্লিষ্ট গুদাম থেকে চুরি হচ্ছে। ভুয়া মালিক সেজে মামলার মাধ্যমে শুল্ক বিভাগের গুদাম থেকে সোনা ছাড়িয়ে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে কাস্টমস বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা জড়িত। নামে-বেনামে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সোনা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের জমা দেয়া সোনার পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা চোরাই পণ্য আটকের পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্তের সুপারিশ করেছে। উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট যুগান্তরে আটক সোনা লোপাট শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সেক্টরে তোলপাড় ওঠে।
উদ্ধার করা অনেক সোনার হদিস নেই :
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে পরিমাণ সোনা আটক করা হয়, পরবর্তীকালে সব সোনার সন্ধান পাওয়া যায় না। অবৈধ সোনা বৈধভাবে আটক করার পর কিছু সোনা আবার অবৈধ হয়ে যায়। সোনা পাচারসংক্রান্ত মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৯৯৫ দশমিক ৭৮ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাইরে ওজন করা হয়নি এমন ১ হাজার ৬৯৩টি সোনার বার ও ৬৮টি সোনার চেইন উদ্ধার করা হয়। এই পরিমাণ সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৩ সালে ঢাকা মহানগরীতে উদ্ধার হওয়া ৮৫টি সোনার বার ও ২০ কেজি ৯ গ্রাম ৫২০ তোলা সোনার মধ্যে মালিকের জিম্মায় ৮৫টি সোনার বার আদালতের নির্দেশে দেয়া হয়। একইভাবে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম রেঞ্জে উদ্ধার হওয়া ১৫ ভরি ৮ আনা ২ দশমিক ৫০ রতি সোনা মালিকের জিম্মায় জমা দেয়া হয়।
এই অবস্থায় দেশের বিমান ও স্থলবন্দরগুলোতে আটক মূল্যবান সামগ্রী যথাযথভাবে কাস্টম হাউস ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে কিনা তা তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আটক মূল্যবান পণ্যের মালিকানা দাবি করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে যেসব পণ্য ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে তা সত্যিকারের মালিকের কাছে যাচ্ছে কিনা এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া চোরাই পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে কিনা তাও যাচাই করা হবে। সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এই তদন্তের সুপারিশ করেছেন। এ জন্য ২৫ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের কাছে একটি চিঠিও দিয়েছেন।
কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার জিয়া উদ্দিন বলেছেন, যেখানেই সোনার চালান উদ্ধার করা হোক না কেন সব বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় এই নিয়মের বাইরে তারা কোনো কাজ করে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নিয়ম-কানুনের কারণে এই সোনা জমা হতে ৭-৮ দিন সময় লেগে যায়। এই সময়ে কাস্টমস গোডাউনে জব্দকৃত সোনাগুলো জমা রাখা হয়। তিনি বলেন, সোনা উদ্ধার হলে তাৎক্ষণিকভাবে কাস্টমস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নিয়ম-কানুন, পুলিশি স্কট, সোনার মান নির্ধারণ, সরকারি ছুটির দিন সব মিলিয়ে আটক সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হতে ৭-৮ দিন সময় লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার পর আর এই সোনার বিষয়ে কাস্টমসহ আটককৃত সংস্থার সদস্যদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এরপর সব দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।
পুলিশের তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সারা দেশ থেকে যে পরিমাণ সোনা উদ্ধার করা হয় তার মধ্যে ১ হাজার ১৪২টি বার কাস্টমস মালখানায়, ২ কেজি ৩৯৯.৬৮ গ্রাম ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মালখানায় ও ১৯৯.৯ গ্রাম বংশাল থানায় রয়েছে। মালিকের জিম্মায় ৮৫টি সোনার বার, ফেনী কোর্টের মালখানায় ২৩৩.৩৭ গ্রাম ১০ তোলা, রাজশাহী ট্রেজারিতে ৩০ তোলা, ঢাকাসহ বিভিন্ন কোর্টের মালখানায় ২.১৫ কেজি সোনা রয়েছে । ২০১১ সালে উদ্ধার হওয়া ২০ কেজি ৫০ গ্রাম সোনা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কোর্টে (এসএমপি) রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সোনা বাংলাদেশ ব্যংকে জমা দেয়া হয়। ২০০৩ সালে উদ্ধারকৃত সোনার মধ্যে ৮৫টি বার আদালতের নির্দেশে আসামির কাছে জমা দেয়া হয়।
আটক সোনা যেভাবে লোপাট হয় :
কাস্টম গোডাউন থেকেই প্রায়শ আটক সোনা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। রক্ষিত এ সোনা লোপাটের সঙ্গে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। কাস্টম হাউসে কর্মরত অসাধু বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া অসৎ নোটারি পাবলিক, স্ট্যাম্প বিক্রেতা, গোডাউনের সিকিউরিটি গার্ড, শুল্ক ও গোয়েন্দা বিচারালয়ের সদস্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মীও এ সিন্ডিকেটের হাতকে শক্তিশালী করছেন। জানা গেছে, কাস্টমস কর্তৃক আটক এবং গোডাউনে রক্ষিত চোরাই সোনাসহ মূল্যবান পণ্য খালাসের বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে কাগজপত্রে বৈধ দেখানো হয়। কাস্টমস আদালত কাগজপত্রের ভিত্তিতে রায় দেন। এরপর সোনার মূল্য ব্যাংকে পরিশোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা খালাস করে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ সময় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে থাকে ভুয়া জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে। আটককৃত সোনার বেশিরভাগ মালিক চোরাকারবারি হওয়ায় তারাও একপর্যায়ে এসব পণ্যের দাবি ছেড়ে দেন। এতে কোনো সাড়া-শব্দ ছাড়াই সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। যুগান্তরের নিবিড় অনুসন্ধানে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট চক্রটি মূলত ১০-১২ বছর কিংবা তারও অনেক আগে আটককৃত সোনাকে টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এ ক্ষেত্রে চক্রটি ওই সময় যাদের নামে চোরাচালানের অভিযোগে মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল এবং মালামাল গোডাউনে জমা রাখার সময় যাদের নামে এজাহারে দেয়া হয়েছিল তাদের নামে ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরি করে। এরপর ভুয়া নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নিকে সত্যায়নও করে নেয়। এসব কাগজপত্রের মাধ্যমে নিজেদের আটককৃত সোনার মালিক দাবি করে কাস্টমস বিচারালয়ে মামলা দায়ের করে। জানা গেছে, ২০০১ সালে এভাবে ১ হাজার ৩০০ তোলা ওজনের সোনার বার লোপাট করে কাস্টমসের সাবেক সহকারী কমিশন ওয়াজেদ আলী ও তার পরিবার। অপর দিকে ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনারের এক বিচারাদেশে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাচালানিদের কাছ থেকে আটক করা ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১ হাজার ৩০০ তোলা স্বর্ণ যে মহিলা আইনজীবী সেজে নিয়ে এসেছেন তিনি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ওয়াজেদ আলীর স্ত্রী। অভিযোগ রয়েছে, ওয়াজেদ আলী কাস্টম হাউসের আইন বিভাগের দায়িত্বে থাকার সময় এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্বর্ণের চালান খালাস করেছেন তার নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে কনসালটেন্ট, আইনজীবী ও নোটারি পাবলিক, ল’য়ার সাজিয়ে।
৫ বছরে রিজার্ভ ৭ মণ :
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ৫ বছরে ১ হাজার ২৪২ কেজি সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭৫ কেজি বা প্রায় ৭ মণ চোরাই স্বর্ণ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। বাকি প্রায় ৯৬০ কেজি বা ২৪ মণ সোনা ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা আছে। মামলা নিষ্পত্তি হলে এসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। সর্বশেষ গত ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩৭ কেজি স্বর্ণ জমা হয়েছে।
সূত্র বলছে, কাস্টম হাউসসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে তাদের কাছে সোনা পাঠানো হয়। তবে কী পরিমাণ সোনা ধরা পড়ল আবার কী পরিমাণ জমা হল এটি নজরদারি করার কেউ নেই। সোনা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মামলা হয়। এরপর তা অস্থায়ীভাবে জমা রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর আদালত থেকে স্বর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিলে, কাস্টমসের কাছে সোনা বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর ফেরত দেয়ার নির্দেশ না দেয়া হলে দুই ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে স্বর্ণের বার হলে তা রিজার্ভে যোগ করে এর বিপরীতে বাজারে টাকা ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর গহনার ক্ষেত্রে নিলাম ডাকা হয়। কারণ গহনা রিজার্ভে নেয়ার সুযোগ নেই। আর নিলামের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং কাস্টমসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাখা হয়। তবে আলোচ্য সময়ে কোনো নিলাম ডাকা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, চোরাই সোনা আটকের পর কাস্টমস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। এরপর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই সোনা হস্তান্তর কিংবা রিজার্ভে নেয়া হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছু না কিছু গোল্ড থাকে। অনেক দেশ ব্যবসার বিষয়টি (মুনাফা) বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গোল্ড কিনে রিজার্ভে জমা রাখে। দাম বাড়লে তা বিক্রি করে দেয়।
ভারতে পাচারের জন্য বাংলাদেশ ট্রানজিট রুট :
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভারতে সোনা পাচারের জন্যই চক্রটি বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। দেশের অভ্যন্তরের যে চাহিদা তা মেটাতে সোনা পাচারের প্রয়োজন হয় না। তাদের মতে প্রতিবেশী দেশে চাহিদা থাকায় অসাধু চক্র দেশে অবৈধ পথে সোনা এনে তা ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত ভারতীয় পাচারকারীরাও। কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতে, দেশের বিমানবন্দরে যে পরিমাণ সোনা আটক করা হচ্ছে তার চাহিদা বাংলাদেশে নেই। একই মত বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) ব্যবসায়ীদেরও।
বিমানবন্দরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মতে, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে আটককৃত ১২৪ কেজি, ১০৭ কেজি এবং ১০৫ কেজির সোনার তিনটি বড় চালান ভারতে পাচার করার জন্যই আনা হয়েছিল। সাম্প্রতিক আটককৃত সোনা ভারতের জন্য। এত সোনার চাহিদা বাংলাদেশে নেই- জোর দিয়ে বলেন এই সোনা ব্যবসায়ী নেতা দিলীপ রায়। এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনও। কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে গোলাম হোসেন বলেছিলেন, ভারতে সোনা আমদানির ওপর বিধি-নিষেধ জারি করায় একটি গ্র“প ভারতে সোনা পাচারের জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে। আগে ভারতে যে কোনো সংস্থা সোনা আমদানি করতে পারত। তবে ২০১৩ সালে ঢালাওভাবে সোনা আমদানি নিষিদ্ধ করে কয়েকটি এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। গত বছরের আগস্টে সোনা আমদানির ওপর ছয় শতাংশ শুল্ক তিন দফায় বাড়িয়ে তা ১০ শতাংশ ধার্য করে দেশটির সরকার।
এ হিসাবে বাংলাদেশে ১০ গ্রাম সোনা আমদানির জন্য ১৫০ টাকা আর সমপরিমাণ সোনার জন্য ভারতে ৪ হাজার ২০০ টাকা শুল্ক গুনতে হয়। বিমানবন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের জন্য নিরাপদ মনে করেন। কারণ বাংলাদেশের বিমানবন্দরে সোনার চালান আটক করলে আসামির বিরুদ্ধে শুধু কাস্টম বিভাগ ব্যবস্থা নেয়। অপর দিকে ভারতে অবৈধভাবে সোনা প্রবেশ করলে ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিমানবন্দর কাস্টমস বিভাগের পাশাপাশি সিবিআই (সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন), দুর্নীতি দমন কমিশন ও আয়কর বিভাগ একযোগে ব্যবস্থা নেয়। শুধু সোনার চালান নয়, একপর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীর সব সম্পদ জব্দ করে নেয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে ভারতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনা চোরাচালানের জন্য বাংলাদেশের হিলি, বেনাপোল, আখাউড়া ও সোনা মসজিদ স্থলবন্দরকে নিরাপদ মনে করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আর তাদের এজেন্টরা জয়ন্তীপুর, হরিদাসপুর, সুটিয়া, বাঁশঘাট সীমান্তকে নিরাপদ মনে করে বেশিরভাগ সোনা এসব সীমান্ত থেকে গ্রহণ করেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন বিভিন্ন দেশের উড়োজাহাজের কর্মকর্তারা। এয়ারপোর্টে কর্মরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন সোনার বড় চালানগুলো বিমানের প্যানেলবক্স, লোডার, পোর্টার, টয়লেটের কমোডের পেছনের চেম্বার, লাগেজ চেম্বার ও কার্গো হলের ভেতর থেকে পাওয়া যায়। এই জায়গাগুলোতে উড়োজাহাজের কর্মকর্তারা ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না।
– মুজিব মাসুদ/মনির হোসেন